স্লিমা বন্দর নগরী। ক্যাফে, রেস্তোরা, গির্জা, অভিজাত দোকানপাটের পশরা, কি নেই। বাস থেকে নেমেই হাঁটা দিলাম নোঙ্গর ফেলা ঝাঁ চকচকে বিশাল ফেরিটার দিকে। ওমা, লোকগুলো আমাদের হাতের টিকেট দেখে হতচ্ছাড়া চেহারার আরেকটা ফেরি দেখিয়ে দিল। তার কাঠের গলুইয়ের ছাল উঠে গিয়ে বাকল উঁকি মারছে। জলদস্যুদের চোরাই জাহাজ যেমন দেখায়। কি আর করা, ছাও পাও গলা ঝুলিয়ে তাতেই লাফিয়ে উঠে পড়লাম।

কাঁধে ঝোলা নামিয়ে দম ফেলে হাত-পা ছড়িয়ে বসেছি মাত্র। বাবা-মা অন্যমষ্কক। এই মওকায় আমাদের তাফসু মিয়া মাঝ দরিয়ায় ঝাঁপ দেবার ফন্দি এঁটে ফেললো। রেলিংয়ের ওপর একদম ঝুঁকে পড়ে পারলে। কিন্তু না, তার মা মতলব বুঝে নিয়ে খপ্ করে ধরে জব্বর এক বকুনি দিয়ে বসিয়ে দিল। মাইকেল ফেলেপ্স হয়ে দুর্দান্ত ডাইভটা আর দেয়া হল না বেচারার। এই দুঃখে সে ভূমধ্যসাগরের তিমি আর ডলফিনদের কানের পর্দা ফাটিয়ে চ্যাঁচাতে লাগলো। উল্টা দিকে বসা ছোট্ট আমালিয়া তখন মায়ের কোলে গভীর ঘুমে মগ্ন। ছেলে মানুষের ভ্যাক কান্না দেখার মত ফালতু সময় তার নেই।

স্পীকারে রেকর্ড করা অস্পষ্ট কন্ঠ কানে ভাঙ্গা ক্যানেস্তারার মত বাজছে। আমরা নাকি এখন মাল্টার জীবন্ত অতীত দেখতে পাবো। অতীত মানে তো ভূত। তা, দেখা যাক এই ভূত কেমন ভূত।

তারপর যা দেখলাম তা ভূতের চেয়ে কিছু কম নয়। ষোলশ শতকের গড়া উঁচু পাঁচিলের যে পেল্লায় কেল্লার দেখা মিলল, তার জেল্লার সাথে পাল্লা দেয়া ভার। সেটা মারাত্মক দক্ষ ভূতুড়ে প্রকৌশলী-কারিগর ছাড়া আর কারো বানাতে পারার কথা না। এই কেল্লাতেই এখন মাল্টার কেল্লাফতে। কত যে পর্যটক আসছে আর পয়সা ফেলে দেখে যাচ্ছে।

আরো চোখে পড়ল সুবিশাল সুরক্ষিত হাসপাতাল, সেই ১৬৪৩ সালে গড়া। কিন্তু সব কিছুতেই একটা যুদ্ধ যুদ্ধ গন্ধ। কারন আর কিছু নাই। মাল্টার চারপাশে লোকজন খালি ছোঁকছোঁক করতো সেকালে। বন্দরটা একবার হাতিয়ে নিতে পারলে অনায়াসে ইতালি, লিবিয়া কি তিউনেসিয়ায় ঢুকে পড়া যায়। একে একে গ্রিক, রোমান, আরব, ফরাসি, ইংরেজ বহুত শাসকই এসেছে। এসেই আবার পরের জনের থাবা থেকে বাঁচতে মাল্টা দেয়াল আরো দুর্জ্ঞেয় করে গড়ে তুলেছে। এই হল প্রাচীন মাল্টার প্রাচীর কাহিনী!

একটু পরই দৃশ্যপট পাল্টে গেল। একটা খাঁড়ি দেখা যাচ্ছে। নাম পিয়েতা। সেখান ভিড় করে দাঁড়ানো চোখ ঝলসানো দারুন সব বিলাসবহুল ইয়ট। মনে একটা চিন্তা খেলে গেল। লোকে বাড়িঘর করে কি করতে? তার চেয়ে এমন একটা বাহারি বজরা কিনে ফেললেই তো পারে। সাত সাগর তেরো নদীতে নাও ভাসিয়ে দিন-দুনিয়া ঘুরে বেড়ানো যেত। আহা!

হঠাৎ টের পেলাম সাগরের তাজা বাতাসে খিদেটা কেমন চাগিয়ে উঠছে। অনেক হয়েছে নীল সাগর। এখন নীল সাগরের জলে যারা থাকে তাদের খেতে ইচ্ছে করছে। ইশ্, মাছের গ্রীল লাঞ্চ হিসেবে খুব জমতো। কি আছে জীবনে! খেয়ে মরে যেতে চাই। সুতরাং, ছোট্ট ফেরিটা পাড়ে ভিরতেই আমরা খেয়ে মরার উদ্দেশ্যে ছুটলাম। আবার সেই দোতালা বাস। যাচ্ছি মার্সাশ্লক (Marsaxlokk) নামের এক মেছো পল্লীতে। সকালের দিকে সেখানে জাল ফেলে ধরা তাজা মাছের বাজার বসে। এখন দুপুর গড়িয়ে গেছে। তবুও মাছ তো রেস্তোরায় মিলবেই।

মার্সাশ্লক জায়গাটার বাড়িঘর ম্যাট্ম্যাটে সাদাটে। বেশীরভাগই দোতালা। কিন্তু এত সাদামাটার ভেতরেও একটা চমক আছে। দুইপাশের সব বাড়ির ফটকগুলো লাল, সবুজ, নীল কিংবা হলুদ। চোখ ধাঁধিয়ে একাকার। দাঁড়িয়ে পড়ে ক্লিক ক্লিক ঝটপট কিছু ছবি তোলা হল। দলের ভেতর ছবির ব্যাপারে সবচেয়ে বেশি উচ্ছ্বাস আদিবার। আদিবার বয়স কম। এতই কম যে যখন সে জন্মেছে ততদিনে আমি বেজার মুখে ক্লাস ফাইভের বৃত্তির পড়া পড়ছি। তো, আদিবার কবলে পড়ে তার কয়েকটা ছবি তুলে দিলাম। সেটা দেখে পেটের খিদে-রাক্ষসটা ‘গ্রাউল গ্রাউল’ শব্দে খুব এক চোট রাগ দেখালো। তারপর আর দেরি না করে ভাজা মাছের ঘ্রান বরাবর প্রায় উড়ে যেতে থাকলাম।

খেয়ে দেয়ে অবিশ্বাস্য একটা বিল চুকিয়ে যখন বেরোলাম, তখন সবার চোয়াল ঝুলে গেছে। ব্যাটারা গলা কেটে রেখে দিয়েছে। আর ভাজা মাছটাও কেমন ঠান্ডা ছিল। সবার আশাভঙ্গ চেহারা দেখে দুষ্টুমি করে বললাম, ‘মাছ তো ডাঙ্গায় তুলেই পাতে দিয়ে দিয়েছে। এর চেয়ে তাজা মাছ আর হয় নাকি? তোমাদের খালি কমপ্লেন আর কমপ্লেন!’। হতাশা তাতে ঘুঁচলো না। পাত্তা না পেয়ে মাথা চুলকে অফ মেরে গেলাম।

আবার বাস। আবার ছুট। এবার গন্তব্য ব্লু গ্রোটো। নীল গুহা। ঝিকিমিকি বালুতে রোদ পড়ে গুহার দেয়ালে ঠিকরায় রংধনুর নানা রঙে। দেখার মত দৃশ্য নাকি। জায়গায়টা পৌঁছাতে পৌঁছাতে বিকাল। দুপুরের বাঘ রোদটা তেজ হারিয়ে মিউ মিউ বিড়াল হয়ে এসেছে। নরম রোদের ওম পিঠ নিয়ে এলোপাথাড়ি হাঁটছি। খাঁড়ি থেকে গুহাগুলো চোখে পড়ে। খাঁড়িটা ভীষন উঁচু। পাঁচ তলার সমান তো হবেই। পাথুরে আর পিচ্ছিল বলে একটু পরপর ‘বিপদজনক’ লেখা খুঁটি গাড়া। ছানাপোনারা দৌড়ে গিয়ে খুঁটিগুলো উপড়ে ফেলার যোগাড় করছে। তাদের সামলাতে হিমশিম খেয়ে গেলাম সবাই মিলে।

ঠুশ! গুলির শব্দের মত লাগলো যেন। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখি আগের দিনের জোব্বা-জাব্বা কাপড় পরে জনা কয়েক খাড়ির কিনারা দাঁড়িয়ে ফাঁকা গুলি ছুড়ছে। কাছেই তাদের বিবিরা মধ্যযুগীয় ঘেরওয়ালা গাউন পরে কতগুলো ঘটিবাটি আগলে মাথায় হাত দিয়ে বসে আছে। গাউনে তাপ্পিও আছে দেখছি।

আমাদের চোখে কৌতূহল খেলে গেল। এই সাজপোশাক ভাড়ায় মেলে। আপনি পয়সা দিয়ে জোব্বা কিনে গায়ে চাপিয়ে কায়দা করে বন্দুকে ঠুশ করবেন আর পেশাদার ছবিয়াল দারুন একটা ছবি খিঁচে দেবে। ছবির এক কোনায় আপনার ঘরে ফেরার অপেক্ষায় হা করে বসে থাকা বউকে ঝাপসা মত একটু দেখা যাবে। ছবি, জামা, আনুষাঙ্গিক মিলে ফুল প্যাকেজ। বউটা অবশ্য নিজের থেকে যোগাড় করতে হবে।

কারবার দেখে মুগ্ধ হয়ে ছানাদের উৎসাহী বাবারা আমাদেরকে ছবি তোলার প্রস্তাবটা দিয়েই ফেললো। আদিবা আর আমি ব্যাপক মাথা নেড়ে প্রস্তাব নাকচ করে দিলাম। আলুথালু বেশে ঘটিবাটি আগলে বসে থাকার মাঝে আমরা কোনো থ্রিল খুঁজে পেলাম না। ছেলেপুলের বাবারা আশাহত ভঙ্গিতে গুহার দিকে এগোলো।

গুহায় ঘুরে আসতে হলে ডিঙ্গি নৌকায় চাপতে হয়। ডিঙ্গিগুলো দেখতে অবিকল শরনার্থীদের অথৈ জলে ভাসিয়ে দেয়া কমলা রঙের রাবার বোটগুলোর মত। তার উপর লাইফ জ্যাকেটের কোন নাম গন্ধ দেখলাম না। মাথা ঘুরিয়ে কোনো ওয়াচ টাওয়ারও চোখে পড়লো না। খুব বোঝা গেল এদের কাজকর্মের ধারা। আমরাও আছি। কেউ পাঁচ ফিট পানিতে সাঁতারে ওস্তাদ কিন্তু বিশ ফিটে গেলেই চালের বস্তার মত ডুবে যাবো। সমুদ্দুর তো বুহুত দূর। আবার কেউ সাঁতার না জানলে কি হবে, প্রচুর ইউটিউব ভিডিও দেখে সাঁতারের থিওরি জানা কাবিল লোক। অতএব, গুহার দেয়ালে আলোর ঝলকানি দেখা আর হল না।

পাথুরে খাঁড়ির বড় চাঁইয়ের ওপর বসে আরো খানিকটা অলস সময় গড়িয়ে যেতে দিলাম। লোকজন ঝপাৎ ঝপাৎ জলে ঝাঁপিয়ে পড়ছে। কেউ সাঁতরেই গুহার দিকে রওনা দিয়েছে। কেউ কেউ আবার খাঁড়ি বেয়ে উঠে এসে একটু জিরিয়ে ফের ঝাঁপাচ্ছে। তাদের সাথে লাল সূর্যটাও হাই তুলে ডুবে যাওয়া শুরু করেছে।

কখন যে শেষ ফিরতি বাসটা এসে চলে গেছে, খেয়ালই নেই। এখন ট্যাক্সি ডাকা ছাড়া উপায় নেই। নইলে রাতের বুফে ডিনার ছুটে যাবে। ইচ্ছা ছিল, কোপাকুপি রকমের খেয়ে দুপুরের ঠান্ডা মাছের বদলা নেবো। ভাগ্য ভালো, ট্যাক্সি জুটলো সময়ের ভেতরেই। সিনেমায় কিডন্যাপ দৃশ্যে যে রকম বিশাল কালো গাড়ি দেখানো হয়, ঠিক তেমন একটা এসইউভি এসে আমাদের তুলে নিয়ে ভোঁ দৌড় দিল।

ড্রাইভার লোকটা ব্রিটিশ। লন্ডনে বাড়ি। নাম ডেভিড। কথাবার্তায় বেশ মিশুক। খুঁটিয়ে জেনে নিল আমরা কোন দেশের লোক, এখন কই থাকি। আবার যেচে পড়ে বলল, লন্ডনের অলি গলি তো দারুন সব বাংলাদেশি রেস্তোরায় সয়লাব। দুই কথার পর আমরা আর কথা খুঁজে পাচ্ছি না দেখে সে ব্রেক্সিট নিয়ে আলাপ পাড়লো। রাজনীতির ঘ্রান পেয়ে নড়েচড়ে বসেছি। রাজা উজির মারার সুযোগ কোন বাঙালি কবে ছেড়েছে? চওড়া হাসির ডেভিড আপন মনে বলে যাচ্ছে, ইউরোপীয় ইউনিয়নের ফাঁদে পড়ে তাদের জাত পাত গিয়েছে। এখন ‘ব্রেক্সিট’ নামের খিরকির দোর দিয়ে পালিয়ে হারানো ইজ্জত উদ্ধার হবে। অস্ত যাওয়া ব্রিটিশ সাম্রাজ্য আবার স্বমহিমায় কান চুলকে, চোখ কচলে জেগে উঠবে। সুতরাং, জয় মাতা ব্রেক্সিট! বেচারার ঘোরটা আমরা কেউ ভাঙ্গালাম না। (চলবে)

বি.দ্র. ছবিগুলো আদিবা আমাত-এর সৌজন্যে।

-ডঃ রিম সাবরিনা জাহান সরকার
গবেষক, ইন্সটিটিউট অব প্যাথোলজি, স্কুল অব মেডিসিন,
টেকনিক্যাল ইউনিভার্সিটি মিউনিখ, জার্মানি

mm

By Rim Sabrina Jahan Sarker

A biologist. My PhD was on chronic lung disease and now doing a postdoc on image analysis on cancer tissues. I enjoy creative writing and running.

2 thoughts on “কমলা রোদের মাল্টা-২”
  1. যাক, আরো একটা পর্ব পাওয়া যাবে। লেখিকাকে অসংখ্য ধন্যবাদ।

    আপনার এই এক পর্ব লেখা আমি তিন দফায় পড়ে শেষ করতে পারলুম। প্রথমবার রাত ৩ টার দিকে পড়তে পড়তেই ঘুমিয়ে পড়েছিলাম, সকাল ৯ টার দিকে ঘুম ভেঙে এক চোখ মেলে মোবাইল হাতে নিয়েই দেখি নীল কমলার মাল্টার দেশ আমার মোবাইলের স্কিনে ভাসছে। আমিও ভেসে বেড়ানোর জন্য ২ প্যারা পড়তেই আবারো ঘুমের নীল সাগরে সাতার দিলুম। আর এখন দুপুর ৩ টায় বাকিটুকু পড়ে নীল সাগর থেকে নিজেকে টেনে তুললুম।

Leave a Reply to Razib Sikder Cancel reply