পৃথিবীতে মানবজন্মের গত দুই লাখ বছরে বহু ঘটনা পৃথিবীকে উলট পালট করে দিয়েছে। অভিঘাত সৃষ্টির সক্ষমতার দিক দিয়ে কোন ঘটনা ছোট, কোন ঘটনা বৃহৎ। পৃথিবীর বুকে অতীতে ঘটে যাওয়া সকল ঘটনা-দূর্ঘটনা ছাপিয়ে ২য় মহাবিশ্বযুদ্ধ যে বিরাট অভিঘাত হেনেছিল, মানবেতিহাসে তার দ্বিতীয় কোন নজির নেই। এই ঘটনা এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের জীবনাচার, তাঁদের সামাজিক, সাংস্কৃতিক, রাষ্ট্রীক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক জীবনপ্রবাহধারা চিরদিনের জন্য এমনতরভাবে প্রভাবিত করেছে যা তুলনারহিত। ইতিহাসের নিকষ কালো অন্ধকারের এই ঘটনা আমাদের সকলের জানা থাকা প্রয়োজন, বিশেষ করে পৃথিবীতে কী ধরণের রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিবেশ এ ধরণের যুদ্ধ ও বিপর্যয় ডেকে আনে তা সম্বন্ধে যথাযথ ধারণা ও বিশ্লেষাত্মক গভীর জ্ঞান পৃথিবীকে পুনরায় সেই পরিস্থিতি হতে রক্ষা করতে পারে। এছাড়া হিটলারের দেশে থেকে হিটলারের কর্ম সম্পর্কে না জানাটা তো অপরাধের পর্যায়ে পড়ে। সেই লক্ষ্যে, আজ হতে ধারাবাহিকভাবে ২য় বিশ্বযুদ্ধের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস প্রতি রোববার প্রকাশিত হবে জার্মান প্রবাসের পক্ষ থেকে। আপনারা সাথেই থাকুন।   

শিশু হিটলার

ঐতিহাসিকেরা যখন এই বিশ্বযুদ্ধের কারণানুসন্ধান করেন তখন বহু বিষয়ের মধ্যে অল্প কটি বিষয়কে গুরুত্ব দিয়ে সামনে নিয়ে আসেন, যেমন, প্রথম বিশ্বযুদ্ধে (১৯১৪-১৯১৮) যে সমস্ত দেশ তাঁর বহু নাগরিককে হারিয়েছে তারা তাদের মতে বিজয়ীদের দ্বারা নিষ্ঠুরতার স্বীকার, ইউরোপের দেশে দেশে গনতন্ত্রহীনতা, এবং ১৯২৯ সালে বিশ্বজুড়ে চরম অর্থনৈতিক মন্দা।  তদুপরি নাৎসি জার্মানির আগ্রাসী সাম্রাজ্যবাদী আচরণ, ফ্যাসিবাদী ইতালি এবং জাপানকেই সকল ঐতিহাসিকেরা একবাক্যে এই যুদ্ধের প্রধান কারণ বলে মানেন। আর এর মাঝে জার্মানিকেই সর্বাগ্রে রাখে পৃথিবীর সকল নাগরিক তো বটেই, ইতিহাসবিদেরাও।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ নিয়ে আলোচনার শুরুতেই যার নাম প্রথমে আসবে সেটি হিটলার। তার সম্পর্কে যথাযথ না জেনে, কী পরিপ্রেক্ষিতে অষ্ট্রিয়ার এক ছোট্ট শহরে জন্ম নিয়ে ধীরে ধীরে হিটলার এক মহাদানবে পরিণত হলেন, সেই সময়ের রাজনৈতিক ও সামাজিক অবস্থার বিশ্লেষণ ছাড়া সেটি বুঝতে পারা কঠিন। হিটলার এমন একটি নাম যার হাতে কোটি মানুষের রক্ত মিশে আছে, মিশে আছে দুঃসহ যন্ত্রণা আর অবর্ণনীয় বেদনার ইতিহাস। 

এডলফ হিটলার অস্ট্রিয়ার ব্রাউনাউ শহরে ১৮৮৯ সালের ২০ এপ্রিল জন্মগ্রহণ করেন। শহরটি অস্ট্রিয়া-জার্মান সীমান্তে অবস্থিত। তার পিতা এলয়েজ ছিলেন কাস্টমস কর্মকর্তা আর মা ক্লারা ছিলেন দরিদ্র কৃষক পরিবারের মেয়ে। আর্থিক অবস্তা সুবিধার হলেও বদরাগী পিতার আচরণের প্রভাব শিশুকাল হতেই হিটলারের উপর পড়ে এবং তাকে একজন অসম্ভব বদরাগী, খিটখিটে মেজাজের অধিকারী হতে ভূমিকা রাখে। ১৯০০ সালে হিটলার লিনৎস শহরে এসে হাইস্কুল শুরু করে। এসময় লিওপোল্ড পোচ নামের ইতিহাসের এক শিক্ষকের সান্নিধ্যে আসে সে। এই শিক্ষক মাত্র এগারো বছর বয়সী হিটলারের শিশুমনে এমন কিছু শিক্ষা প্রবেশ করতে ভূমিকা রাখেন যা পরবর্তী জীবনে হিটলারের জীবনাদর্শন গড়ে  তুলতে তুমুল কাজে দেয়। এই শিক্ষক ছিলেন, ইতিহাসবিদদের মতে, কট্টর জার্মান জাতীয়তাবাদের প্রশ্নে এক অগ্নিমূর্তি। অস্ট্রিয়া প্রাচীন আমল থেকেই একটা প্রকাণ্ড সাম্রাজ্যের অংশ ছিল, সে তুলনায় জার্মানি নতুন দেশ। কিন্তু উভয় দেশের জনগণ এক ভাষায় কথা বলে। কট্টরবাদীদের মাঝে ধীরে ধীরে দুই দেশ এক করার সুদূরপ্রসারী স্বপ্ন লালিত হতে থাকে। ইতিহাসের শিক্ষক থেকে মহান জার্মানি গড়ার ক্রোধান্বিত আকাঙ্ক্ষার বীজ কিশোরমনে রোপণ করে হিটলার প্রাইমারী স্কুল যথাযথভাবে শেষ করে, কিন্তু কোন ধরণের সনদ ছাড়াই মাত্র ষোল বছর বয়সে হিটলার পরবর্তী পড়ালেখার পাঠ চুকিয়ে ফেলেন। 

হিটালারের আঁকা অস্ট্রিয়ান

অধুনা ধর্মনিরপেক্ষবাদীরা শুনলে আকাশ থেকে পড়তে পারেন, কিন্তু লাখ লাখ মানুষকে খুনের দায় যার ঘাড়ে, কিশোরকালে সেই হিটলার একজন চিত্রশিল্পী হতে চেয়েছিলেন। তার পিতা রাজি না হওয়ায় সে স্বপ্ন পূরণে দেরি হলেও, ১৯০৩ সালে পিতার মৃত্যুর পর শিল্পী হওয়ার পথ খুলে যায়। ভিয়েনা একাডেমী ও ফাইন আর্টসে ভর্তি হতে চেষ্টা করেও সফল হতে না পেরে যাযাবরের মত ঘুরে ফিরে মানুষের স্কেচ আর পোষ্টকার্ড এঁকে ভিয়েনায় জীবন ধারণ শুরু করেন। প্রায় বেকার জীবন হিটলারকে কঠিন বাস্তবতার সম্মুখীন করে। দারিদ্রতা আর চাওয়ামত চিত্রশিল্পী হওয়ার পথ রুদ্ধ হওয়ার কারণ তাকে আর জেদি ও নিষ্ঠুর করে তোলে। এই সময়ের কথা উল্লেখ করে তিনি লিখেছেন, “ওই সময়ের প্রতি আমি ঋণী যে সময় আমাকে কঠিন মানুষের রূপান্তরিত করেছে, এবং আমি আজও বিশ্বাস করি আমি আর কঠোর হতে পারি।”

ভিয়েনার পথে ঘাটে ঘুরে ফিরে সে নীরবে চারিদিক পর্যবেক্ষণ করে বেড়ায়। কফিশপে প্রতিদিন পত্রিকার মাধ্যমে রাজনীতির হালহকিকত জেনে নেয়। এই সময়টায় ভিয়েনায় কমিউনিস্টদের উত্থান চলছে। এরা ক্ষেত্রবিশেষে রাজপথে ভায়োলেন্স করছে। কমিউনিস্টদের একটা বড় অংশ ইহুদী। অস্ট্রিয়ায় তখন হাবসবুর্গের সাম্রাজ্য যেখানে বহু নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠী একসাথে বাস করতো আর যার একটা বড় অংশ ছিল ইহুদী। ১৯১০ সালে ভিয়েনায় প্রায় পৌনে দুই লাখ বাস করতো। এটি হিটলারের পছন্দ ছিল না। নাগরিক হিসেবে তিনি অস্ট্রিয়ার ছিলেন ঠিকই, এথনিক এবং ভাষাগত পরিচয়ে তিনি জার্মান ছিলেন। সেকারণেই কিনা তিনি স্বপ্ন দেখতেন জার্মানির মত এমন একটি ঐক্যবদ্ধ রাষ্ট্রের, যেখানে শুধু জার্মান ভাষাভাষীরাই বসবাস করবে এবং অন্যান্য নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠী-ভাষা-সংস্কৃতির মানুষের সেখানে কোন স্থান হবে না। এই প্রত্যয় তিনি বারবার ব্যক্ত করেছেন তার নিজের লেখা বই “মাইন ক্যাম্প” এ। এই বইটি ঘৃণাবাদী উগ্র ডানপন্থী খ্রিস্টানদের কাছে পবরর্তীতে “বাইবেল” হিসেবে কুখ্যাতিলাভ করে। ইহুদীদের প্রতি অতিশয় ঘৃণা থেকে হিটালার তার বইয়ে লিখেছেন, “ভিয়েনাতে আমি যেখানেই গেছি সেখানেই ইহুদী। যত বেশি আমি তাদের দেখি তত বেশি তাদের অন্য মানবসমাজ থেকে আমি আলাদা করি। আমি অত্যন্ত দৃঢ়ভাবে তখন থেকে নিজেকে ইহুদীবিরোধী হিসেবে নিজেকে দাঁড় করাই।”

মাত্র একুশ বছর বয়সেই হিটলার এমন এক উগ্র জাতীয়তাবাদী আদর্শে নিজেকে দীক্ষিত করে যা শুধু বিশ্বাস করে সহিংসতা ও সন্ত্রাসের মাধ্যমে ইহুদীমুক্ত একক জার্মান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার। “ভিয়েনা এখন অবধি আমার জন্য একটা কঠিন রাজনৈতিক শিক্ষা হয়ে রয়েছে। এখানে আমি এমন এমন শিক্ষা অর্জন করেছি যা কখনোই আমার ভেতর হতে মুছে যায়নি”- “মাইন ক্যাম্প” বইয়ে হিটলার লিখেছেন। 

অস্ট্রিয়ার সেনাবাহিনীতে বাধ্যতামূলক যোগদান এবং আর উন্নততর ভবিষ্যতের কথা ভেবে হিটলার জার্মানির মিউনিখ শহরে চলে আসেন ১৯১৩ সালে। জার্মানির প্রতি হিটলারের আনুগত্য ছিল বরাবরই। এরই মাঝে ১৯১৪ সালে পৃথিবীতে শুরু হয়ে গেল প্রথম বিশ্বযুদ্ধ। জার্মানির আর্মিতে তিনি নিজেকে অন্তর্ভুক্ত করলেন। জার্মানির হয়ে যুদ্ধ করলেন ফ্রান্স ও বেলজিয়ামে। যুদ্ধচলাকালীন দুইবার তিনি সাহসিকতার জন্য পুরস্কৃত হলেন। ১৯১৬ সালে ১লা জুলাই হতে নভেম্বরে ফ্রান্সের সমে নদীর তীরে ইতিহাসের এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ হয় মিত্রবাহিনী ব্রিটিশ ও ফরাসীদের সাথে জার্মান সৈন্যদের। এতে তিরিশ লাখের অধিক সৈন্য অংশ নিয়ে প্রায় দশলাখ মৃত্যুবরণ করে। নৃশংসতার দিক দিয়ে এটিকে পৃথিবীর অন্যতম ভয়াবহ ব্যাটল হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। এই যুদ্ধে হিটলার অংশ নিয়ে বৃটেনের গ্যাস আক্রমণে মারাত্মক আহত হন। এ ধরণের গ্যাস সাধারণ শ্বাসযন্ত্র, চোখ ও ত্বকের ক্ষতি করে থাকে। সাময়িকভাবে কেউ কেউ অন্ধও হয়ে যেতে পারে। তবে অল্প কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই দৃষ্টিশক্তি ফিরেও আসে। কিন্তু হিটলারের দৃষ্টিশক্তি ফিরল না। (চলবে)

ধন্যবাদান্তে
জাহিদ কবীর হিমন
বার্লিন থেকে
৮ সেপ্টেম্বর ২০১৯

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ নিয়ে জার্মান প্রবাসের এই ধারাবাহিক আয়োজন নিয়ে আপনার কোন মতামত বা পরামর্শ আমাদের জানাতে পারেন এখানেঃ [email protected]

mm

By Jahid Kabir Himon

এডিটর (Editor): জার্মান প্রবাসে মাস্টার্স in Internet Technologies And Information Systems Leibniz University Hannover বর্তমানে বার্লিনের একটি কোম্পানিতে রোবটিক্স প্রোসেস অটোমেশনে (RPA) কাজ করছি

Leave a Reply