আগের পর্ব এখানেঃ হঠাৎ স্বর্ণকেশী!

লতা আমার এড়ানোটুকু খেয়াল করল ঠিকই, কিন্তু তাতে অপ্রস্তুত হল না। বরং স্মিত হেসে অদ্ভূত পরিষ্কার উচ্চারণে আমার নামটা ধরে বলল, “অনিক, পরিচিত হয়ে ভাল লাগল। আচ্ছা, ঐ কথাই থাকলো, ডাক্তারের টারমিন শেষে এক ঘন্টা পর, মানে এগারোটায় আমি ক্যাফেটায় থাকবো। চলে আসবেন কিন্তু।“ আমি নির্লিপ্ত উত্তর দিলাম, “দাঁতের ব্যাপার, কিছুই বলতে পারি না। ডাক্তার কতক্ষন বসিয়ে রাখবে, তার উপর নির্ভর করবে আসতে পারব কি না। না পারলে ধরে নেবেন, চেম্বারে আটক বসে আছি। বিন্দুমাত্র বিরক্ত না হয়ে লতা সায় দিয়ে কিছুটা ক্ষান্ত দেবার ভঙ্গিতে বলল, “আচ্ছা, কোন জোরাজুরি নেই। না আসতে পারলে ঐ যে বললেন, ধরে নেব ডাক্তারের ষড়যন্ত্র”। আর সেই সাথে খিলখিল হাসি। ঠিক যেন পাহাড়ি ঝরণা। আরো একবার বেসামাল ভ্রান্তিতে পড়ে গেলাম। সম্পূর্ণ অপরিচিত এই স্বর্ণকেশীর হাসিটুকু বিচিত্র কোন কারণে বড্ড পরিচিত ঠেকতে লাগল। কোনমতে একটুকরো ভাঙ্গা হাসি দিয়ে বিড়বিড় করে বললাম, “দেরি হয়ে যাচ্ছে, আসি তাহলে এখন।“ কি উত্তর আসলো, না শুনেই পা চালালাম বিক্ষিপ্তভাবে। আর বাতাসে এলোমেলো হাত চালিয়ে ভ্রান্তিটাকে তাড়িয়ে দিতে চাইলাম। আজকের দিনটা এমন গোলমেলে কেন?

ভ্রান্তির অতলান্তিক থেকে আমাকে বের করে আনলো কফিশপটাই। চলতে চলতেই চোখে পড়ল, বেশ বড়সড় জায়গা জুড়ে দাঁড়িয়ে আছে ক্যাফেটা। একটাই দোকান। তার এক দিকে কফির আয়োজন। আরেকদিকে তুর্কি ডোনার কাবাব রেস্তোঁরা। ডোনার কাবাব মানে আমাদের দেশে হালের শর্মা আর কি। কয়েক বংশ ধরে জার্মানিতে ঘাঁটি গাড়া তুর্কিদের প্রতি জার্মানদের একটা সহজাত প্রচ্ছন্ন বিদ্বেষ কাজ করে। কিন্তু দুপুর কি সন্ধ্যায় জার্মান জাত্যাভিমানটা বুক পকেট থেকে নামিয়ে রেখে সেই তুর্কিদেরই হাতে বানানো এক আধটা ডোনার কাবাব পেটে চালান না দিলে চলেই না এদের। এখন বাঙ্গাল আমার মনটাও দ্রুতলয়ে ভেবে চলছে, একটা চিকেন ডোনার কাবাবযোগে দুপুরের খাবারটা সেরে ফেললে কেমন হয়? এই-সেই ভেবে শেষ পর্যন্ত রাস্তার ওপার থেকে ভেসে আসা ম ম কাবাবের ঘ্রানেরই জয় হল। ঠিক করলাম, দাঁতের একটা গতি করেই সোজা ডাক্তারের হাত থেকে ছুটে কফিশপে চলে আসব। স্বর্ণকেশী না স্বর্ণলতা কি যেন নাম, তার দেখা পেলে ভালো, না পেলে কবজি ডুবিয়ে ডোনার কাবাব আর সাথে ঠান্ডা এক বোতল কোক মেরে দিয়ে ঘাউক ঢেকুর তুলে বাসায় গিয়ে অলস ভাতঘুম দেয়া যাবে। তবে তারি মাঝে কেন যেন মনে হল নীল টুপি লতাকে কফি কাপ হাতে নিয়ে বসে থাকতে দেখলে মন্দ হত না। জীবনে ঘাস-লতা-পাতা, আর সবুজের দরকার আছে। পরক্ষনেই নিজের ছেলেমানুষি চিন্তায় বিরক্ত হলাম। সহিস হয়ে মনের ঘোড়ার লাগাম টেনে ডানে বামে আর না তাকিয়ে সোজা আসল ঘোড়ার ডাক্তারের চেম্বারের পথে এগোতে থাকলাম।

গন্তব্যে পৌঁছানোমাত্রই অভ্যর্থনায় থাকা ফ্রাউ ক্যাথরিন আমার হাতে এক তাড়া কাগজ ধরিয়ে দিয়ে একটা প্রশস্ত হাসি হেসে কাজে ডুবে গেলো। বলে রাখি, ফ্রাউ মানে “মিস”; সম্মনার্থে যেমন বলা হয়ে থাকে। আমি এক পলক কাগজগুলো দেখে ভুরু কুঁচকে বললাম, এগুলো তো গতবারই পূরণ করে গেলাম, আবার কেন?” ফ্রাউ ক্যাথরিন সহাস্যে জানাল, “আরে বুঝলে না, জিডিপিআর, জিডিপিআর। তোমার আগের সব ডাটা আমরা মুছে দিয়েছি। কি আর করা, এখন আবার একটু কষ্ট কর।“ মনে পড়ে গেল, পুরো ইউরোপ জুড়ে জিডিপিআর মানে জেনারেল ডাটা প্রটেকশন রেগুলশেন ওরফে তথ্য প্রতিরক্ষা আইন নিয়ে তোলপাড় চলছে। অগত্যা বাধ্য ছেলের মত কলম চেয়ে নিয়ে বসে গেলাম ফর্ম পূরণ করতে। নামধাম, ঠিকানা, ডায়েবেটিস আছে কিনা জাতীয় মামুলি প্রশ্নের তালিকা। কিন্তু ধৈর্য্যের বিচ্যুতি ঘটল যখন এসে ঠেকলাম, “আপনি কি অন্তঃস্বত্তা? কোন মাস চলছে? এটি কি আপনার প্রথম সন্তান? এর আগের কয়টি সন্তান আছে, নিচে উল্লেখ করুন। সন্তানপ্রসবকালীন জটিলতা থেকে থাকলে তাও উল্লেখ করুন, ইত্যাদি ইত্যাদি…।“ ঘ্যাচাং ঘ্যাচাং ক্রস চিহ্ন দিয়ে কোনমতে কাগজগুলো ফ্রাউ ক্যাথরিনের হাতে ফেরত দিলাম আর মহিলা একটা চটুল হাসি দিয়ে ঘোষণা দিল, ক্রস দিয়েছো কেন? ক্রস মানে তো “হ্যাঁ“।“ এই বলে সে হ্যাহ্যা করে পুরুষালি ভঙ্গীতে হেসে উঠল। বিব্রত আমিও হাত বাড়িয়ে দিয়েছি ঘ্যাচাংগুলোকে শুধরে দেবো বলে। “ওমা, তোমার গালে কি টোল পড়ে? কি দারুন!” ফ্রাউ ক্যাথরিনের কথায় অজান্তেই হাত চলে গেল গালে। সাতদিনের দাড়িও কি যথেষ্ট না হতচ্ছাড়া মেয়েলি টোলটাকে ঢেকে দিতে? কি লাভ হল তাহলে এত কষ্ট করে ভাব নিয়ে দাড়ি না কামিয়ে থেকে? মাঝখান দিয়ে খালি গাল কুটকুট করছে। ধুর! বাঁচাল এই মহিলা লাগামহীন বলে চলছে, “এই তোমার দেশে সব ছেলেই কি তোমার মত লম্বা, এমন তামাটে গায়ের রঙ? খাড়া নাক আর কালো চুলের সাথে নিকষ কালো চোখ? ইশশ্।” তার চোখে মুখে কপট আফসোসের ছাপ। বিরক্তির মাত্রা আমার এখন সপ্তমে চড়েছে। মহিলা বাঙ্গালির ছেলের রূপটাই দেখেছে, বিরূপ দেখে নি। হুংকার দিয়ে বলতে ইচ্ছা করছে, “এ্যাও! একদম চোওওপপ!” কিন্তু তার বদলে ভদ্রতার একটা নিরব হাসি দিয়ে ভুলগুলো শুধরে আবার এসে বসলাম প্লাস্টিকের কটকটে গোলাপি চেয়ারের সারিতে।

কি রঙ রে বাবা। মনে হয় ডাক্তারবাবুর বউ পছন্দ করে কিনেছে। তার উপর চেয়ারগুলো ক্ষুদ্রাকৃতির। এই লিলিপুটের চেয়ারে কতক্ষন গালিভারের মত বসে থাকতে হবে ভাবছি আর কেমন করে যেন চোখ আটকে গেলো দেয়ালে টাঙ্গানো ছবির দিকে। পাহাড়ি মেঠো পথ দিয়ে এক তরুণী হেঁটে যাচ্ছে। হাতের বাহারি ঝুড়ি উপচে পড়ছে রঙ্গিন বুনো ফুলের ভিড়ে। অবাক হয়ে দেখলাম মেয়েটার মাথায় বাঁধা নীল রুমাল অবিকল লতার টুপিটার মত নীল। আরো ভড়কে গেলাম যখন খেয়াল করলাম ঝুড়ি হাতে ছবির মেয়েটা ক্রাচে ভর দিয়ে হাঁটছে। কি দেখছি এসব? চোখ কচলে ভালো করে আবার তাকাবো, কিন্তু চোখ খুলতেই হাত ঘড়িটায় দেখলাম কয়েক গাছি উলের সুতা আটকে আছে। নীল রঙের। ছাড়িয়ে আনলাম সযত্নে। আলতো করে দুই আঙ্গুলের মাঝে ফেলে ছোট্ট একটা নরম নীল বল বানিয়ে ফেললাম। এর মাঝে আমার ডাক পড়ল। “হ্যান্ডসাম অনিক, এবার তোমার পালা।“ ফ্রাউ ক্যাথরিনের মিষ্টি গলা আমার মেজাজ আরেকবার তিরিক্ষে করে দিল। একদম পিত্তি জ্বলে গেলো। উঠতে উঠতেই চটজলদি উলের বলটার জন্যে একটা নিরাপদ জায়গা খুঁজলাম। কি মনে করে মানিব্যাগটা খুলে কয়েন রাখার কোঠরে সেটাকে রেখে দিলাম। কেন রাখলাম? জানি না। নেহায়েৎ ছেলেমানুষি হয় তো, ঠিক জানি না। উঠে দাঁড়িয়ে আরেকবার ছবিটার দিকে চোখ গেল। ক্রাচটা গেল কই? আশ্চর্য্য! ঝুড়ি হাতে মেয়েটার আরেক হাতে তো একটা ভেড়ার বাচ্চা!! বেরসিক ভেড়াটা আবার ঝুড়ি থেকে ফুল টান দিয়ে মনের সুখে চিবুচ্ছে!

(চলবে)
০১.১০.১৮
–ডঃ রিম সাবরিনা জাহান সরকারঃ মিউনিখ, জার্মানি


আগের পর্ব এখানেঃ হঠাৎ স্বর্ণকেশী!

হঠাৎ স্বর্ণকেশী!-তিন

mm

By Rim Sabrina Jahan Sarker

A biologist. My PhD was on chronic lung disease and now doing a postdoc on image analysis on cancer tissues. I enjoy creative writing and running.

2 thoughts on “হঠাৎ স্বর্ণকেশী! -দুই”
    1. ধন্যবাদ। মনে হচ্ছে খাল কেটে জার্মান কুমির আনছি। কারন, গল্প কেমন করে শেষ করব, কিচ্ছু জানি না। দোয়া করবেন।

Leave a Reply to Rashidul Hasan Cancel reply