গভীর রাতে আরব দেশের একটি বিমানবন্দর। ট্রানজিট যাত্রী হিসেবে পাসপোর্ট কন্ট্রোল ডেস্কের সামনে বুয়েট গ্র্যাজুয়েট তিন যুবক। গন্তব্য জার্মানির ফ্রাঙ্কফুর্ট শহর।

যুবকদের ভাব “সেইই কড়া“! কেউ আগস্টের গরমেও মোটা স্যুট-টাই পরিহিত, রাতের বেলাতেও কারো চোখে কালো সানগ্লাস, কারো হাতে হাই-অফিসিয়াল ব্রিফকেস। সময়-স্বল্পতায় পত্রিকায় “উচ্চশিক্ষার্থে বিদেশ যাত্রা“ বিজ্ঞাপন দেওয়াটাই যা বাকী ছিল!

কর্তব্যরত মহিলা অফিসার (সম্ভবত শ্রীলঙ্কান বংশোদ্ভূত) পাসপোর্টগুলো একে একে চেক করে ভ্রু কুঁচকিয়ে জিজ্ঞেস করলো, “তিনজনের পাসপোর্টই DUPLICATE, ঘটনা কি?“

প্রথম জন: আমি আগের পাসপোর্টটা হারিয়ে ফেলেছি। থানায় জিডি করার পর নতুন আরেকটি পাসপোর্ট ইস্যু হয়েছে, তাই এই DUPLICATE স্ট্যাম্পটা বসানো।

অলৌকিকভাবে দ্বিতীয় ও তৃতীয় জনেরও একই উত্তর! এমনিতেই হাতে লেখা পাসপোর্টে ডুপ্লিকেট সিল, সঙ্গে সবার একই “গরু হারানো“ গল্প। ব্যাস, ‘আদম’ পাওয়া গেছে!

ভদ্রমহিলা ভিতরে গিয়ে ২০ মিনিট পর ফিরে এসে, “তোমরা ফ্রাঙ্কফুর্টে যাচ্ছ না। ফিরতি ফ্লাইটেই ঢাকায় ব্যাক করছো“- বলেই পাসপোর্টগুলো নিয়ে চলে গেলো।

ইয়া মাবুদ-এলাহি!! এখন উপায়?

আসলে, তৎকালীন ‘বুশল্যান্ডের’ ভিসা আবেদন ২ বার প্রত্যাখ্যাত হলে ওরা পাসপোর্টের শেষ পাতায় অত্যন্ত “যত্ন করে“ USA VISA REJECTED সিল দিয়ে দিতো। যেভাবে গরুর পশ্চাৎদেশে সিল দিয়ে বাংলাদেশ সীমান্তে পাচার করা হয়!

ঐ পাসপোর্টে স্টুডেন্ট-ভিসার আবেদন করলে জার্মান দূতাবাসও ক্রিমিনাল ভেবে ঘ্যাচাং করে “ভিসা রিফিউজ“ করবে, এই দুশ্চিন্তা থেকেই নতুন পাসপোর্টে আবেদন।

আমরা তিনজনই সেই একই জেলেপাড়ার কুবের মাঝি। ইমিগ্রেশন অফিসার নিশ্চিত যে, আমরা গলাকাটা ডুপ্লি পাসপোর্ট নিয়ে “মরলে শহীদ, বাঁচলে ইউরোপ“ টাইপ যাত্রী। শুধু নৌকায় না উঠে উড়োজাহাজে রওনা দিয়েছি, এই যা পার্থক্য!

অফিসাররা একটু পর পর এসে আমাদের চেহারা-ছবি, নাক-নকশা দেখে যাচ্ছে। বোর্ডিং -পাস, ভিসা- কিছুই পাত্তা দিচ্ছে না! বন্ধুদের চোখ ছলছল, আমরা বাকরুদ্ধ ! স্বপ্ন ভেঙ্গে খান খান, সবাই এখন মুড়ি খান!

আশেপাশের অনেকের মুখেই বিদ্রুপের হাসি। চৌচির হৃদয় ডুকরে কেঁদে বলছে, “তুই লাল পাহাড়ের দেশে যা, বাংলাদেশের বুকে যা, ইত্থাক তুকে মানাইছে না রে….“ কিন্তু বাড়ি ফিরে কি জবাব দিবো?

মাইকে ঘোষণা হচ্ছে আমাদের নাম। লাস্ট এন্ড ফাইনাল কল ফর মিঃ অমুক, মিঃ তমুক। হাতে মাত্র কয়েক মিনিট! নাহ, যা হয় হবে, প্রতিবাদ করতে হবে!

‘হ্যালো, এক্সকিউজ মি’ বলে ডাকতেই ভদ্রমহিলা এলে বললাম, ‘বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে ফোন করে তোমাকে প্রমাণ করতে হবে যে পাসপোর্টগুলো ভুয়া। জার্মান ফেডারেল শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে বলতে হবে যে তারা এই নামে কাউকে বৃত্তি দিয়েছে কিনা। এই নাও সব পেপারস। তা না পারলে তুমি আর্মি নামালেও আমরা ফ্রাঙ্কফুর্ট যাবোই।’

‘জায়গামতো‘ ভাব দেখিয়ে কাজ হলো! কিছুক্ষণ পর সে পাসপোর্টগুলো এনে রাজ্যের বিরক্তিতে ডেস্কে রেখে চলে গেলো। যমে-মানুষে টানাটানি শেষে মানবতার বিজয়!

পাসপোর্টগুলো থাবা দিয়ে নিয়েই শরীরের শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে দৌড়। কোথায় স্যুট-টাই, কোথায় সানগ্লাস! সেই দৌড়ের গতি মাপলে উসাইন বোল্টও লজ্জায় তার সব অলিম্পিক মেডেল আমাদেরকে ভাগ করে দিয়ে গুলিস্তানে বসে শরবত বিক্রি করতো।

সর্বশেষ যাত্রী হিসেবে প্লেনে ঢুকে অন্য যাত্রীদের রক্তচক্ষু দেখেও পাত্তাই দিলাম না। কারণ এইমাত্র আমরা উসাইন বোল্টকে হারিয়ে পথে বসিয়ে এসেছি, এরা আর কি!

সিটে বসার পরপরই প্লেনটি উড়তে শুরু করলো ফ্রাঙ্কফুর্টের উদ্দেশ্যে। শুরু হলো জীবনের দ্বিতীয় অধ্যায়ের। সময়কাল: আগস্ট ২৮, ২০০১।

০১/০৫/২০১৮

mm

By টিম জার্মান প্রবাসে

আমি জার্মান প্রবাসে! আপনাদের সাথে ছিলাম, আছি, থাকব! :)

One thought on “আরব দেশের একটি বিমানবন্দরে একদিন!”

Leave a Reply to Mohammad Mainuddin Cancel reply