মনটা প্রচন্ড খারাপ। আমার সামনে একটা ১৯ বছরের যুবক নীরবে কাঁদছে আর আমি কিছুই করতে পারছি না। কালকে দুপুরেই পরিচয় হয়েছে ছেলেটার সাথে। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে ব্যাচেলর পড়তে এসেছে। উইন্টার সেমিস্টারে প্রচুর ছাত্রী/ছাত্র ভর্তি হওয়ায় এসময়ে আমাদের ছোট শহরে বাসা পাওয়া প্রায় দুস্কর। তাই আমরা ফ্ল্যাটমেটরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি, বাসা না পাওয়া দুই একজনকে আমাদের বসার ঘরে কিছুদিনের জন্য রাখার ব্যবস্থা করব। এরপরে এরা নিজেরাই নতুন বাসা খুজে নিতে পারবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ফেসবুক গ্রুপে মোহিতের পোষ্ট দেখে তাকে সহযোগিতার সিদ্ধান্ত নিই। মেসেজ আদানপ্রদানের মাধ্যমে তার সম্পর্কে একটুআধটু জানার সুযোগ হয়। তার আচরণে মুগ্ধ হয়ে আমাদের বাসায় আসার নির্দেশনা দিই।

দিল্লী থেকে এয়ার ইন্ডিয়ার সরাসরি ফ্লাইটে ফ্রাঙ্কফুর্ট বিমানবন্দরে নেমে দুইটা ট্রেন পাল্টিয়ে তিনটার দিকে এখানে পৌছে সে। সাধ্যমত আপ্যায়ন করে তাকে বিশ্রাম নিতে বলে ফুটবল খেলতে যাই। এখানে সাধারণত ভারতীয়রা একে অপরকে সাহায্য করতে দ্বিধা করে না। তাই খেলার মাঠে পরিচিত কয়েকজন ইন্ডিয়ান ছাত্রের সাথে তার সাক্ষাতের জন্য সময় নির্ধারণ করি, যেন তারা তাকে ভর্তি, ক্লাস আর পরিবেশের সাথে খাপ খাওয়াতে সহযোগিতা করতে পারে। সন্ধ্যার দিকে হাটতে বের হয়ে তার পরিবার সম্পর্কে জিজ্ঞেস করি।দুই ভাইবোনের মধ্যে ছোট সে। বাবা খুব ভাল চাকরি করেন। বড় বোন সিএ সম্পন্ন করে এখন ইন্টার্ণশীপ করছে দিল্লীতে। নয়াদিল্লীর ইন্দিরা গান্ধী বিমানবন্দর থেকে ১০ মিনিট দুরত্বে তাদের ফ্ল্যাট। দিল্লীর বাইরে কোনদিন বেড়াতে না গেলেও একা একা এখানে এসেছে শুনে মনে মনে অনেক বাহবা দিলাম। তার শোবার ব্যবস্থা করে নিজ রুমে ফিরে এলাম।

সকালে ঘুম থেকে ওঠে ফেসবুকে একটা ফ্ল্যাটের বিজ্ঞাপন চোখে পড়ল। একজন ছাত্র দুইমাসের জন্য রুম ভাড়া দিতে চায়। ফোন করে আজকে সন্ধ্যায় দেখা করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে নাস্তা করতে মোহিতকে ডাকতে গেলাম। খাওয়ার সময় বাসা পাওয়ার সুখবর দিতেই মাথা নিচু করে সে বলল, “আমি কালকেই ইন্ডিয়ায় ফেরত যাচ্ছি।”
চমকে উঠে জিজ্ঞেস করলাম, “কিন্তু কেন? কালকে রাতেই না তোমাকে অনেক হাসিখুশি দেখলাম?”
“আমি সারারাত ঘুমাতে পারি নাই। মনে হচ্ছে, আমি জার্মানীতে টিকতে পারব না।”
“আমি জানি তুমি পরিবারকে মিস করছ, কিন্তু সবারই প্রথম দিকে অনেক খারাপ লাগে, সময়ের সাথে সব ঠিক হয়ে যায়।”
“আমি ইতিমধ্যে পাপার সাথে কথা বলেছি, উনিও বলেছেন মন না চাইলে দেশে ফেরত আসতে।” তার হঠাত আমূল পরিবর্তনের কারণ জানার চেষ্টা করলাম। পরিবার ছেড়ে থাকা, নতুন ভাষা শেখা আর অড জব করে খরচ চালানো সম্ভব হবে না বলে প্রচন্ড ভীত সে।

“আমিও ১৬ বছর বয়সে গ্রাম ছেড়ে রাজশাহীতে গিয়ে প্রতিদিন কাঁদতাম, বাড়িতে বেড়াতে এসে মাকে জড়িয়ে ধরে বলতাম, আমি আর ওখানে ফিরে যেতে চাই না মা। আঁচলে চোখ মুছে মা বলত, জীবনে বড় হতে হলে যে এটুকু কষ্ট করতেই হবে বাবা। অনেক দিন পরপর বাবার চিঠি পেতাম। তখনো মোবাইল ফোনের তেমন একটা সুবিধা না থাকায় পনের দিন পরে ল্যান্ডফোনে বাবার কন্ঠ শোনার সৌভাগ্য হত, তাও সর্বোচ্চ পাঁচ মিনিট। অথচ তুমি চাইলেই তোমার বাবা-মার সাথে স্কাইপেতে কথা বলতে পারো। আর পরশু থেকে ক্লাসে গিয়ে অনেক নতুন বন্ধু পাবে, তাদের সাথে পড়াশুনা, খেলাধুলা আর আড্ডাবাজি করে তোমার মনের বেদনা লাঘব হতে থাকবে। তোমার বাবা-মার স্বপ্ন পূরণ হবে।” তাকে বোঝানোর শেষ চেষ্টা করলাম।

আমার কথায় আশ্বস্ত হয়ে পুনরায় বাসায় কথা বলল সে। ওর মা প্রথমদিকে অনেক রাগ করলেও ছেলের মন রক্ষায় বাড়ি আসতে সায় দিলেন।
শেষমেশ বাধ্য হয়ে সবার সাথে দেখা করার কথা ফিরিয়ে নিলাম। সামনের চেয়ারে বসে ছিল সে। আমার কথা শেষ হতেই মনের সাথে যুদ্ধে পরাজয় ও স্বপ্ন ভাঙার বেদনায় কাঁদতে শুরু করল সে।

তার জন্য ফিরতি টিকেট কাটা হয়ে গেছে। কালকে সকালেই দেশের উদ্দ্যেশে বিমানে উঠবে সে। মন থেকে কামনা করি, মোহিত যেন ভারতে গিয়ে অনেক ভাল থাকে।

mm

By Shariat Rahman

আমি বর্তমানে রাইন-ওয়াল ইউনিভার্সিটি অফ এপ্লায়িড সাইন্সে সায়েন্টিফিক এসিস্ট্যান্ট (Wissenschaftlicher Mitarbeiter) হিসেবে কাজ করছি। ২০০৯ সালে বুয়েট থেকে আইপিইতে ব্যাচেলর আর ২০১২ সালে রাইন-ওয়াল ইউনিভার্সিটি অফ এপ্লায়িড সাইন্স থেকে বায়োনিক্সে মাস্টার্স সম্পন্ন করি। অবসর সময়ে সোস্যাল মিডিয়া, আড্ডাবাজি আর খেলাধুলা নিয়ে ব্যস্ত থাকার চেষ্টা করি।

2 thoughts on “হোম সিকনেস ও প্রবাস জীবন”
  1. নি:শ্বাস বন্ধ হয়ে গেছে ভাইয়া! উনার সবকিছু দেখেই আমরা প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। বড় ধাক্কা খেলাম

Leave a Reply to Hammad Cancel reply