আমি, তুমি, সে- আমরা আমাদের জীবনের সূচনা করেছি একটি দেহে পরাশ্রয়ী হয়ে, সেই শরীর থেকে পুষ্টি নিয়ে গড়েছি নিজেদের দেহ; সেই আশ্রয়ী শরীরটি না থাকলে আমাদের মানব জীবন সম্ভব হত না। সেই আশ্রয়ী পোষক দেহটি হচ্ছে একজন নারীর; মাঝে মাঝেই আমার জানতে ইচ্ছে করে সেই নারীদের সম্পর্কে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি কি রকম- অনেক সময়ই সন্তোষজনক কোন উত্তর পাই না। আশেপাশের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অনেক ঘটনায়, হাসি-তামাশায়, ঠাট্টায় এরকম কিছু নজরে পড়ে যেগুলোতে সমস্যা আছে বলেই আমার মনে হয়েছে।

এই যেমন রুবেল-হ্যাপি’র ব্যাপারটা নিয়ে হাসি-ঠাট্টা-তামাশা, বিশেষত, ইংল্যান্ডের সাথে খেলাটার পরে সর্বস্তরের মানুষ এ নিয়ে রসিকতার চর্চা করেছে যাতে অনেক সময় তা ব্যক্তিগত সীমা ছাড়িয়েছে আর অনেক কথায় আমাদের গভীরে থাকা নারীদের সম্বন্ধে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গির একটা দৃষ্টিকটু দিক প্রকাশিত হয়েছে। গ্রামের স্কুলের ছেলেটি থেকে শুরু করে তারকা-বড় তারকা- উঠতি তারকা, প্রগতিশীল-প্রতিক্রিয়াশীল চিন্তাভাবনার, ভাব-ধারণার মানুষজন, প্রবাসী কেউই বাদ যাননি এই ব্যাপারটা নিয়ে মুখরোচক মন্তব্য করতে। রসবোধ বাড়ানোর জন্য হ্যাপি’র ফেইসবুক স্ট্যাটাস চুরি করে তা দিয়ে ছড়া রচনাও হয়েছে- এটা কতটুকু নৈতিকতার মধ্যে পড়ে তা আমার জানা নেই।

এখানে আরেকটা স্ট্যাটাসের উদাহরণ দেই-

“রুবেল তোর জন্য দশটা হ্যাপি সাপ্লাই দিমু” (হুবহু কথাগুলো মনে নেই, তবে স্ট্যাটাসটা মোটামুটি এরকমই ছিল)

এটা আনন্দের আতিশয্যে দেয়া একটা স্ট্যাটাস হয়তো কিন্তু তার কথায় চলে এসেছে নারীদের সম্পর্কে এরকম একটা ধারণা নিয়ে চলা একটা সামাজিক ছবি যেখানে নারী হচ্ছে মনোরঞ্জণের পাত্রী বা ভোগের বস্তু। এই ধারণা আমাদের মধ্যে প্রোথিত তাই এই কথায় হয়তো সে (যে এই স্ট্যাটাসখানি দিয়েছে) কোন অস্বাভাবিকতা খুঁজে পায়নি। কিন্তু বিপরীত ধাঁচের কথা হলে হয়তো তার কাছে ধরা পড়ত, অর্থাৎ যদি বলা হত “হ্যাপি তোর জন্য দশটা রুবেল সাপ্লাই দিমু”- তখন হয়তো মজাটা ছাড়িয়েও কথার অস্বাভাবিকতাটা ধরা পড়ত। এই অস্বাভাবিকতা ধরা পড়ে বলেই হয়তো যখন দেখি প্রবাসে কোন বাংলাদেশি মেয়ে ইউরোপিয়ান কোন ছেলের সাথে প্রেম করছে তখন ভদ্রদের কাছ থেকে ভদ্রভাবেই একটা অভদ্র ইঙ্গিত চলে আসে,- ‘সে অনিয়ন্ত্রিত জীবন যাপন করছে!’

এই অস্বাভাবিকতার জন্যই হয়তো Nivedita N Kumar এর  “Yes, I wear a bra. Yes, it shows. So?”­,  লেখাটিতে আমাদের বিরূপ প্রতিক্রিয়া হয়, কেননা এখানে পুরুষের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন আনতে বলা হয়েছে। ‘সময়ের কন্ঠস্বর’-এ এর একটা বাংলা অনুলিখন প্রকাশিত হয়, সেখানকার কিছু মন্তব্য তুলে দিচ্ছি এখানে-

‘…আপনার ইচ্ছা করছে ছোট পোশাক পড়তে বিশেষ অঙ্গ প্রদর্শন করতে, সেটা আপনি করবেন আর অন্যের ইচ্ছার করবে আপনার বিশেষ অঙ্গে স্পর্শ করতে, অবলোকন করতে এটাই স্বাভাবিক। ব্যাংকের ভল্ট না বন্ধ করে আপনি যদি অভিযোগ করেন টাকা লুট হয়েছে তবে কি মনে করেন অপরাধীদের সহযোগিতা করার দায় থেকে আপনি বেঁচে যাবেন?

‘……হরিণ বাঘের সামনে গিয়ে বলছে,হ্যাঁ আমি আপনার সামনে দাঁড়িয়ে আছি তাতে কী? আপনি আমাকে কেন খাবেন?…’

অর্থাৎ নারী নারী কিংবা মানুষ নয় সম্পত্তি কিংবা শিকার। এরকম তুলনা আরো আছে যা আমরা ব্যবহার করে থাকি এটা বুঝানোর জন্য যে নারীরা পুরুষের অধীনস্থ। এক বন্ধু তার ফেইসবুক দেয়ালে এই লেখাটি প্রকাশ করলে সেখানেও অনুরূপ মন্তব্য দেখা যায় এবং সেখানকার মন্তব্যকারীদের অর্ধশিক্ষিত বা অল্পশিক্ষিত বলার কোন অজুহাত থাকে না। হুবহু মন্তব্যগুলো দিতে পারলে ভালো হত কিন্তু বন্ধুটি ঐ পোস্টটি মুছে দিয়েছে। মন্তব্যগুলো এরকম-

 ‘যারা এরূপ পোশাক পরে তারা কখনোই ভালো মেয়ে না; তাদের উচিৎ শিক্ষা হওয়া উচিৎ।’

‘মিষ্টি খাবার ঢাকা না থাকলে তাতে মাছি তো বসবেই

আমি এই ব্যাপারটা অবাক হয়ে লক্ষ্য করেছি নারী অধিকার বা নারী সম্পর্কিত আমাদের দৃষ্টিভঙ্গির কথা আসলেই এর বিপরীতে নারীর পোশাকের কথাটা চলে আসে, সবাই ব্যস্ত হয়ে পরে নারীদের কাপড় দিয়ে পেঁচিয়ে বাক্সবন্দি করে ফেলতে, তাহলেই যেন সব সমস্যার সমাধান; আর এই হেতুই হয়তো কিছু লোক নারীদের খাবারের সাথে তুলনা দেয়- কখনো তেঁতুল, কখনো মিষ্টি, কখনো ললিপপ। যদি নারী তোমার কাছে ললিপপ-ই মনে হয় তবে বিয়ে করে একজনের সাথে সুখ-দুঃখ ভাগ করে নেয়া কেন? সংসার করা কেন? প্রতিদিন একটা করে ললিপপ কেনো- সবসময়য় সাথে রাখতে পারবে, যখন ইচ্ছা মুখে পুরবে, আবার বের করে কাগজে মুড়ে পকেটে রেখে দিবে! একজন নারীকে-একজন মানুষকে ললিপপ মনে করা কেনো?

আমি আসলে মুকেশ সিং (দিল্লীর বাসে গণধর্ষণ এর হোতা) আর তাদের মধ্যে কোন তফাৎ দেখি না যারা ধর্ষণের জন্য সরাসরি বা ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে নারীদের পোশাককে দায়ী করে বা করতে চায়; সুযোগ পেলে তারা মুকেশ সিং হয়ে উঠতে সময় নিবে না।

পরিশেষে বলি বাংলাদেশে এরকম ধ্যান-ধারণার লোকের মানুষের পরিসংখ্যান কিরকম সে সম্পর্কে আমার ধারণা নাই; কিন্তু আমি সবশ্রেণীর মানুষের মাঝেই ‘নারীরা পুরুষের অধীনস্থ’ এরকম একটা মানসিকতা দেখেছি।

mm

By Manir Hossain

মাস্টার্স শেষ করেছি বায়োনিক্স-এ, থাকি এসেন, জার্মানিতে।

One thought on “মানসিকতা”

Leave a Reply