চিন্তা-ভাবনা-১

প্রবাসে আসছেন। দীর্ঘদিন দেশে যেতে পারেননি। দেশে যাবেন বলে যখন টিকিট কাটলেন ঠিক সেই সময় ভুঁইফোড়ের মতন কিছু লোকের আগমণ ঘটে যাবে। ঘটবেই। এদের সারা বছর দেখা যায়না। মরে পচে গলে গেলেও তাদের দেখা পাওয়া যায়না। কিন্তু বিমানের টিকিট কাটলেই কিভাবে যেন নোটিফিকেশন পৌছে যায় তাদের কাছে। ধরেন, এক ঘন্টা আগে নতুন মোবাইল নাম্বার নিয়েছেন; সেই নাম্বার আপনি নিজেও জানেন না। দেখা যাবে সেই নম্বরে কল এসেছে। কি কথপকথন দেখা যাক এক পলক,
-হ্যালো কে বলছেন?
=হ্যালো সুফল! ভালো আছো ভাই?
-হ্যাঁ ভাই, কে?
=আমি জব্বার! অমুক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ি। ঐযে সেদিন পহেলা বৈশাখে ইলিশের কাঁটা ছাড়াতে যেয়ে পরিচিত হলাম।
(আমি কিন্তু পহেলা বৈশাখে যাইই নাই; তবুও ভদ্রতার খাতিরে হ্যাঁ হ্যাঁ করে গেলাম)!
-অ ভাই! তা কি খবর?
=এইতো! শুনলাম দেশে যাচ্ছো। তা তোমার লাগেজে যদি একটু জায়গা হত তাহলে তোমার ভাবির জন্যে কিছু পাঠাতাম। ওজন বেশি হবেনা।
আমি আইগুই করে রাজি হলাম। মাল আসলো। সেই মালের ঠেলায় আমার নিজের কিছু জিনিস রুমে রেখে এক রকম বাঁকা হয়ে হাঁটা শুরু করলাম।

কিছু ভাবি আছেন। অন্য সময় সুফল একটা কুত্তারবাচ্চা হলেও এই সময় প্রাণের দেবর! কল করেই,
-সুফল, আব্বা খুব অসুস্থ! হাস্পাতালে। বাঁচবেনা মেইবি। তুমি কী একটু আব্বার জন্যে কেনা স্যুট-প্যান্ট সাথে নিবা? (পরিস্কার ফিঁচ ফিঁচ কান্না!!)
মরণ পথের যাত্রী কাকা স্যুট দিয়ে কি করবেন বুঝলাম না; তার দরকার কুরআনের আয়াত! যাইহোক বুঝলাম মাল গচাইতে চাচ্ছেন। এক পিস স্যুটের স্থানে বোনের জন্যে তিনটা কালো পলিথিনে মোড়ানো বারো জোড়া ব্রা, পেন্টি, টুথব্রাশ… (আর মনে নাই)

এবারতো দেশে নামলেন। কিভাবে যেন দেশের নাম্বারও পেয়ে যায়। কি বাবা মাকে জড়ায় ধরবেন; আপনাকে ফোনের পর ফোন করতে হবে। মাল হাতে পৌছানোর পর আপনি হয়ে যাবেন একদম ডট ভাই। এরপরে দেশ থেকে আসার পথেও আঁচার, তেল, হলুদ, মশারী, বঙ্গবাজার থেকে কেনা সস্তার কুড়ি জোড়া আন্ডারওয়্যার, ভাবিদের…, (ওহ্‌, মাই আল্লাহ্‌) …

এইসব মাল গুলো চিনে রাখা জরুরী। দেশে গেলে যেন কাক পক্ষী আর একদম কাছের বন্ধু-বান্ধবী ছাড়া আর কেউ টের না পায়।

চিন্তা-ভাবনা-২

-তোমার বাবা কি করেন?
=রাজমিস্ত্রি।
চমকে উঠলাম। গত বছর ১৯ বছরের ফুটফুটে সুন্দরী মেয়ে ‘নাদিন’ আমার প্রতিবেশী হয়ে এলো। প্রশ্নের এক পর্যায়ে খুব স্বাভাবিক প্রশ্ন ছিলো এটি। তার থেকেও নির্লিপ্তভাবে উত্তর দিলো নাদিন।

বাংলাদেশে ১৯ বছরের একটি মেয়ে বা ছেলে কি এতটা সহজভাবে বলতে পারবে তার বাবা বাজারে সবজি বিক্রি করে? কিংবা রেষ্টুরেন্টে পরোটা ভাজে কিংবা নাদিনের বাবার মত রাজমিস্ত্রির কাজ করে? ১০০ জনকে জিজ্ঞেস করলে একজন স্বীকার করবে কিনা আমার সন্দেহ জাগে।

বাংলাদেশে সবজি বিক্রেতা, রাজমিস্ত্রি পেশার বাবার মেয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে এটাই হলো চরম অবাস্তব ভাবনা। যদি পড়েও থাকে তবে তাকে স্বাভাবিকভাবে গ্রহন করে নেয়ার মানুষের সংখ্যা আমাদের সমাজে একদম শূন্য। এখানে সমাজে বিত্তশালী ব্যাক্তির সন্তানদের আলাদা চোখে দেখা হয়। আমার স্কুল বেলা বা কলেজ বেলাতেও এই দৃশ্য ছিলো একদম স্বাভাবিক। তোমার আব্বা কি করেন? আমার আব্বার অমুক দোকান আছে কিংবা আমার আব্বা অমুক পেশার! সাথে সাথে শুরু হয়ে গেলো তাকে মাথায় তুলে নাচা।

প্রতিটা পেশাই পেশা। সবাই যদি বিল গেটস হতে চাইবেন তবে মাঠে সবজি বোনা আর বাজারে মাছ বেচার মানুষ খুঁজে পাওয়া যাবেনা। তাহলে কি হবে? আমাদের মিডিয়াও এই কাজটা করেন খুব সুক্ষভাবে। অমুক রিকশাওয়ালার মেয়ে রংপুর মেডিকেলে চান্স পেয়েছে এখন আর পড়তে পারছেনা। রিকশা চালিয়ে পেট চালানো কি গুরুতর অপরাধ? সাহায্য থাকবে সাহায্যের স্থানে সেখানে পিতার পেশা সামনে আসে কিভাবে?

আর একটা খুব দুঃখজনক উদাহরণ দেই। কুষ্টিয়াতে মেথর পট্টির ছেলে মেয়েদের পড়ালেখার সুযোগ নেই। জিজ্ঞেসে করতেই পৌরসভার এক অফিসার কাকা বলেছিলেন,
-সমাজে ওদের কাজ গু সাফ করা। ওদের পড়তে দিলে এই কাজ করবে কে?
আজ থেকে বছর দশেক আগের কথা। আমার বয়সী মেথর পট্টির অনেকেই মদ খেয়ে মাতাল হয়ে হাতে বালতি আর ঝাড়ু দিয়ে মানুষের টয়লেট পরিস্কার করতে দেখেছি কিংবা দেখছি। কি এক আজব সমাজে আমাদের বসবাস… সত্যিই নির্মম পশুদের মত আমাদের ভাবনা।


এছাড়া পড়তে পারেনঃ

mm

By Shah Waez

International Student Program Moderator bei horads 88,6 - Hochschulradio Stuttgart. Wohnt in Stuttgart.

Leave a Reply