মা দিবস উপলক্ষে “জার্মান প্রবাসে” তাদের পুরো ম্যাগাজিন মা সম্পর্কিত লেখা দিয়ে সাজাবে। যদিও দেশের বিভিন্ন সাহিত্যিকগণ আমার মায়ের সাহিত্যকর্ম ও বিভিন্ন বিষয় নিয়ে লিখছেন তারপরও ভাবলাম আমারও কিছু লেখার আছে। এই সুযোগে কিছু না বলা কথা বলা যাবে। তবে একজন লেখক হিসাবে আমার মায়ের সাহিত্যকর্ম নিয়ে কোন তাত্ত্বিক আলোচনায় আমি যাব না। আমি বলব আমার মায়ের কথা।

তবে যার নিকট থেকে এই ‘জীবন’ পাওয়া তার সম্পর্কে লিখতে গিয়ে সব একটু এলোমেলো লাগছে। সেলিনা জামান একজন কবি, একজন গীতিকার, একজন কথা সাহিত্যিক। তিনি আমার মা।  যিনি মায়ের দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে অনেক চাকুরির অফার ত্যাগ করেছিলেন। যার ফলাফল হলো আমাদের দু’ভাই বোনের বর্তমান অবস্থা। আমি একটি পাবলিক ভার্সিটিতে শিক্ষকতা করি। বর্তমানে ইরাসমাস স্কলারশিপ নিয়ে জার্মানিতে মাস্টার্স করছি। আর ছোট বোন মার্কেটিং বিভাগে রাজশাহী ভার্সিটিতে পড়ছে।

কিন্ত  শুধু এতটুকুই কি আমার মায়ের কৃতিত্ব? তাঁর কৃতিত্ব অন্যান্য ক্ষেত্রেও। যেমন, আমার কর্মক্ষেত্রে আমি সব সময় কিছু স্বার্থপর, দুর্নীতিগ্রস্থ ও তৈলবাজ মানুষ দেখি এবং আমি তাদের থেকে নিজেকে আলাদা করে ফেলতে পারি নিমিষেই। আমার সব সময় মনে হয়, আমি ঐ দলের একজন। এই যে ভাবনাটা এটা একজন সন্তানের মাঝে গড়ে তোলার কৃতিত্বটা কিন্ত একজন মায়ের। আমার মা এদিক দিয়ে শতভাগ সফল।

আমার মা আমাদেরকে নিয়ে সব সময় দুশ্চিন্তা করেন। ছেলে মেয়েদের জন্য তাঁর দুশ্চিন্তার শেষ নেই। আমি আমার স্টুডেন্ট লাইফে অনেক ছেলে মেয়ে দেখেছি এখনও দেখছি এবং তাদের সাথে তাদের মায়ের সম্পর্ক গভীরভাবে দেখেছি। কোন মাকে আমার মায়ের মত এত দুশ্চিন্তা করতে দেখিনি। প্রতিদিন তিনি এখনও আমার খোঁজ নেন। তাঁর দুশ্চিন্তার একটা উদাহরণ দেয়া যাক। আমি একদিন আমার বন্ধু লোটাসের মোটর সাইকেলে চেপে ওর সাথে ধানমন্ডি থেকে নিকুঞ্জ যাচ্ছিলাম। পথের মাঝে আমার মায়ের ফোন। মা মোটর সাইকেলে চাপার কথা জেনে ফেলেন। আর যায় কোথায়? বাকী পথ তিনি আমাকে পারলে বাসে উঠিয়ে ছাড়েন এমন অবস্থা। অথচ আমি ভাবছিলাম একখানা মোটর সাইকেল কিনবো ঢাকা শহরের জ্যাম থেকে বাঁচার জন্য।

এইযে এত টেনশন এসবের উৎস কোথায়? বেশী বেশী ভালোবাসা থেকেই এসবের সৃষ্টি। ভালোবাসার এত বাড়াবাড়ি থাকা সত্বেও আমরা তাঁর সন্তানেরা কেউ উচ্ছৃঙ্খল হইনি। এতো ভালোবাসার মাঝে রেখেও আশ্চর্যজনক এক ধরণের রেষ্ট্রিকশনের ভেতর দিয়ে তিনি যে কিভাবে আমাদের বড় করে তুলেছেন তা তিনিই ভালো বলতে পারবেন। তবে আমাদের ফ্যামিলীতে এক অন্য রকম বন্ধন আছে হয়তো সে কারনেই এটা সম্ভব হয়েছে। অন্য ফ্যামিলীর মতো আমাদের ফ্যামিলীতে ভালোবাসা দেখানোর আদিখ্যেতা নেই। তবে যে ভালোবাসা আছে তা অন্তরের অন্তস্থল থেকে উৎসারিত, যা একটুকুও কম নয়।

আমাকে যদি বলা হয় তোমার আশেপাশের মানুষগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশী অসুস্থ কে থাকে? তাহলে প্রথমেই আমার সামনে আমার মায়ের মুখটা ভেসে উঠবে। তিনি বেশীর ভাগ সময়ই কোন না কোন কারণে অসুস্থ থাকেন। তারপরও তিনি তাঁর অসুস্থতা সব সময় গোপন রাখার চেষ্টা করেন। অতিথিপরায়নতা কিংবা কেউ অসুস্থ হলে তাঁর সেবা করা, এদিক থেকে তাঁর জুড়ি নেই। অসুস্থ মানুষের সেবা করতে করতে তিনি যে নিজেই অসুস্থ হয়ে পড়েন সেদিকে তাঁর খেয়াল থাকেনা। ২০০৫ সালের কথা। আমি তখন ফুড ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে লেভেল থ্রি তে পড়ি। ভার্সিটির হলে থাকি। মার কাছে শুনলাম তাঁর একটি লেখা বের হয়েছে আমাকে নিয়ে-প্রথম আলো পত্রিকার ছুটির দিনে। লেখার নামটি ছিল ‘আমার অভী’। তিনি যে একজন অনেক বড় মাপের লেখক তা এই লেখাটা পড়লেই বোঝা যায়। লেখাটা পড়লেই আমার চোখ এখনও ভিজে আসে। সন্তান বাৎসল্যতা এই লেখাটিতে চমৎকারভাবে তিনি তুলে ধরেছেন। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো এই লেখাটি প্রকাশ হবার পর আমি মোটামোটি বিখ্যাত হয়ে গেলাম ভার্সিটিতে। অনেকেই আমার সাথে পরিচিত হওয়ার পর বলেছে-ও তুমিই সেই অভী! আমার হলের এক বড় ভাইয়া প্রায়ই আমাকে ভুল করে শোভন বলে ডাকতেন। এই লেখাটা পড়ার পর আমাকে ঠিক নামে ডাকতে আর ভুল হয়নি তার।

আমাকে নিয়ে আরও একটি লেখা প্রথম আলোতে প্রকাশ হয়েছিল। আর এগুলো একজন সন্তান হিসেবে আমার অনেক গর্বের বিষয়। যখন কেউ আমাকে জিজ্ঞেস করেন, তোমার বাবা মা কি করেন? আমি প্রথমেই আমার মায়ের কথা বলি, বলি আমার মা একজন লেখক। গর্ব করে বলার মতো এই একটি জিনিষই আমার আছে। এবং যাদের বলি তাদের কৌতুহলটা উপভোগ করি। আমি জানি একজন লেখক হিসেবে তাঁর এখনও বহু পথ পাড়ি দেবার আছে, তা নিয়ে আমি ভাবি না। আমার মা একজন লেখক এটাই আমার কাছে অনেক বড় গর্বের একটা বিষয়। আমার মা শারীরিক বিভিন্ন সমস্যা সত্বেও লিখে চলেছেন এবং বিভিন্ন সংস্থা থেকে পুরস্কৃতও হয়েছেন। তিনি যেন সুস্থ থাকেন এবং আরো বেশী বেশী গর্ব করার কারণ যেন হন-এটাই আল্লাহর কাছে আমার প্রার্থনা।

(ছবি সংগৃহীত)

লেখাটি প্রথম প্রকাশিত হয়েছেঃ জার্মান প্রবাসে – মে, ২০১৪ – মা দিবস বিশেষ সংখ্যা

mm

By Sarwar Inam Auvie

Studies Food Science at KaHo Sint - Lieven. Past: Dublin Institute of Technology (DIT) and Bangladesh Agricultural University. Lecturer at Hajee Mohammad Danesh Science and Technology University. Lives in Berlin, Germany.

Leave a Reply