স্বপ্ন কি তাই – যা আমরা কেবল রাতে দেখি?  স্বপ্নের বিস্তৃতি অনেক বেশি। স্বপ্ন তো তাই – যা পূরণের জন্য আমরা দিনরাত অক্লান্ত পরিশ্রম করি। আজ যে স্বপ্নের কথা বলব তার শুরুটা ছিল দশ বছর আগে, যার উদ্যোক্তা ছিলেন জার্মান প্রবাসী কিছু বাংলাদেশী মানুষ। সময়টা ছিল ২০০৭, সেই বছর উচ্চ মাধ্যমিক ও সমমানের পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশিত হয় ৮ই জুন। ফলাফল প্রকাশের পর বাংলাদেশের প্রথম সারির পত্রিকাগুলো নিয়ম করে সুবিধা বঞ্ছিত, হার না মানা মেধাবী ছাত্রদের সাফল্য গাঁথা প্রকাশ করত। সেই সাফল্যের কিছু গল্প এক বাঙালি ভদ্রলোকের মনে নাড়া দেয়। একটা গল্প ছিল এমন- দরিদ্র মেধাবী মেয়েটা সারাদিন চেয়ারম্যানের বাড়িতে কাজ করার পর রাতে উঠানে কুপি জ্বালিয়ে পড়াশুনা করত। মানুষের বাড়িতে খেটে খাওয়া মেয়েটা পিছিয়ে যায়নি তার লক্ষ্য থেকে, সে জিপিএ ফাইভ অর্জন করে দেখিয়ে দিয়েছিল সমাজকে। তো এমন কিছু গল্পের প্রেক্ষিতে বাঙালি সাইফুল্লাহ ভাবতে থাকেন এদেশের সুবিধা বঞ্ছিত কিন্তু অদম্য, মেধাবীদের জন্য কিছু একটা করতে হবে। উনি আলোচনা শুরু করলেন আরও কিছু প্রবাসী বাঙালির সাথে এবং সবাই যথেষ্ট সাড়া দিয়েছিলেন। সেই প্রেক্ষিতে ২০০৮ সালের এপ্রিলে সাইফুল্লাহ, জিয়াউল মালিক সহ আরও কয়েকজন উদ্যমী বাঙালি মিলে দাড় করান ‘Bangladesch Jugendförderung’ (বাংলাদেশ ইয়থ প্রমোশন)নামের একটি অলাভজনক বেসরকারি সংস্থা। সেই থেকে শুরু হয় স্বপ্নের।

সংস্থার পরিচালনা পরিষদের সাথে কিন্তু বেশ কিছু জার্মান ব্যক্তিও জড়িত আছেন, তারা সকলেই আমাদের দেশ এবং দেশের মানুষদের ভালবেসে এই কাজে যুক্ত হয়েছেন। গেরহার্ড বেলিটজ একবার বাংলাদেশ ঘুরতে যেয়ে দেশের মানুষের আতিথেয়তায় মুগ্ধ হয়ে যান। এরপর অতিথিপরায়ণ বাংলাদেশের মানুষদের জন্য কিছু করার সুযোগ পেয়ে তিনি যারপরনাই খুশি হন। আরেকজন হলেন ড. মার্টিন ব্রাউন, পেশায় তিনি একজন চিকিৎসক। নব্বই শতকে বাংলাদেশ ঘুরে এসে এবং বাংলাদেশী রোগীদের চিকিৎসা করে উনি বাংলাদেশের মানুষের উপকারে কাজ করার জন্য প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হন। বলা বাহুল্য, মিউনিখ-বাসী অসংখ্য বাঙালি ‘হাউজ ডাক্তার’ দেখানোর প্রয়োজন হলে মার্টিন ব্রাউনের কাছে ছুটে যান উনার বন্ধুবাৎসল্যের জন্য। আরেকজনের কথা না বললেই নয়,উনি হখশুলে আলেনের প্রফেসর; প্রফেসর হের্টিং। সংস্থার পিছনে এই বিদেশী মানুষগুলোর অবদান অসামান্য।

যাই হোক, ‘Bangladesch Jugendförderung’ এই সংস্থার মূল লক্ষ্য বাংলাদেশের মেধাবী শিক্ষার্থী মূলত যারা স্কুলের বিভিন্ন পর্যায়ে মেধার স্বাক্ষর রাখে কিন্তু অর্থের অভাবে পড়াশুনা চালিয়ে যেতে পারে না তাদের সাহায্য করা। অন্যান্য যেকোনো সংস্থা থেকে এই সংস্থা সম্পূর্ণ আলাদা এই দৃষ্টিকোণ থেকে যে, এখানে অনুদিত প্রায় পুরো টাকাটা ছাত্র ছাত্রীদের মাঝে বিতরণ করা হয়। অবাক হচ্ছেন– কিভাবে সম্পূর্ণ টাকা অনুদান দেয়া সম্ভব?  সম্ভব,কারন পরিচালনা পর্ষদের সাতজন ব্যাক্তির কেউই তাদের কাজের জন্য কোনও পারিশ্রমিক দাবী করেন না। জার্মানি থেকে বাংলাদেশে টাকা পাঠানোর খরচ কমানোর জন্য বছরে দুই থেকে তিন বার ঢাকার সেন্ট্রাল একাউন্টে টাকা পাঠানো হয়, পরবর্তীতে সেন্ট্রাল একাউন্ট থেকে এলাকাভিত্তিক ভাবে বিভিন্ন একাউন্টে টাকা ট্রান্সফার হয়। শিক্ষার্থীরা সঠিক সময় মতো বৃত্তি পাচ্ছে কিনা তা নিশ্চিত করার জন্য প্রতিটি এলাকাভিত্তিক একজন করে বিশ্বস্ত কোঅর্ডিনেটর নির্ধারন করা আছে। কোঅর্ডিনেটরের দায়িত্ব হলো শিক্ষার্থীকে টাকা বুঝিয়ে দিয়ে শিক্ষার্থীর নাম, ছবি, স্বাক্ষর–মানে সমস্ত কাগজ পত্র ওই শিক্ষার্থীর জন্য জার্মানিতে দায়িত্বরত সদস্যের কাছে পৌঁছে দেয়া। মজার ব্যাপার হলো, বাংলাদেশে অবস্থানরত কোঅর্ডিনেটররাও কোন পারিশ্রমিক নেন না। সম্পূর্ণ ব্যাপারটিতে স্বচ্ছতা বজায় রাখার জন্য জার্মানি থেকে শিক্ষার্থীর স্কুলের প্রধান শিক্ষকের সাথে এমনকি স্বয়ং শিক্ষার্থীর সাথে কথা বলে জানা হয় শিক্ষার্থী সময়মত বৃত্তির টাকা পাচ্ছে কিনা। এছাড়াও কোন সদস্য জার্মানি থেকে দেশে গেলে নিজ পকেটের টাকা খরচ করে খোঁজ নিয়ে আসেন বৃত্তির আওতাভুক্ত শিক্ষার্থীদের। আরো একটি মজার ব্যাপার হলো, এই সংস্থাটির নিবন্ধন করা আছে মিউনিখের ট্যাক্স অফিসের সাথে। ‘ট্যাক্স এডভাইজার’  সংস্থার কাগজ পত্র ‘ট্যাক্স অফিসে’ পাঠানো বাবদ যে পারিশ্রমিক পেয়ে থাকেন তার পুরোটা এই প্রতিষ্ঠানে পুনরায় অনুদান হিসেবে দেন। বছর শেষে দেখা যায়, যে পরিমাণ আর্থিক সহযোগিতা এই সংস্থা পেয়ে থাকে তার থেকে মাত্র পাঁচ শতাংশেরও কম টাকা বিভিন্ন খাতে খরচ হয়, বাকি ৯৫ শতাংশ টাকা ব্যয় করা হয় ছাত্রছাত্রীদের পড়াশুনার কাজে। এই একটি বিষয় এই প্রতিষ্ঠানকে কে অন্যান্য দাতব্য প্রতিষ্ঠান থেকে সম্পূর্ণ আলাদা করে রেখেছে।

দশ বছর ধরে একটু একটু করে বিস্তৃত হওয়া এই সংস্থার সাফল্যের ইতিহাস কম নয়। মাত্র বাইশ জন সদস্য এবং ৪০ জন বৃত্তির আওতাভুক্ত ছাত্রছাত্রী নিয়ে কাজ শুরু করা সংস্থার বর্তমান সদস্য সংখ্যা প্রায় ১৬০ জন এবং প্রায় ২৭০ জনের মত ছাত্রছাত্রীদের এরা সাহায্য করে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত। তাছাড়া যেসব শিক্ষার্থী এই সংস্থা থেকে উপকৃত হচ্ছে তাদের অনেকেই দেশের স্বনামধন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনা করছে, অনেকেই পড়াশুনার পাশাপাশি টিউশনির মাধ্যমে আর্থিক অসচ্ছলতা কাটিয়ে সচ্ছল জীবন যাপন করছে। ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা প্রসঙ্গে সংস্থার একজন অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা বললেন “আমরা এতদিন ষষ্ঠ থেকে দ্বাদশ শ্রেণী পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের দেখাশোনার দায়িত্বে ছিলাম কিন্তু  সকলের সহযোগিতায় এ বছর এটাকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে উন্নীত করতে সক্ষম হয়েছি। আর এটা সম্ভব হয়েছে ‘ebay foundation’ এবং ‘math works’ নামে দুইটা সংস্থার অনুদানের কারণে। আমাদের পরিকল্পনা নয়- বরং স্বপ্ন হলো; যেসব শিক্ষার্থী এই সংস্থা থেকে কিছুটা হলেও সাহায্য পেয়ে একটা সুন্দর জীবন গঠনের পথে এগিয়ে যাচ্ছে, একদিন তারাও আরও দশটা সুবিধা বঞ্ছিত মেধাবী শিক্ষার্থীর সাহায্যে এগিয়ে আসবে। এভাবেই দেশ একদিন উন্নতির পথে এগিয়ে যাবে।তবেই আমরা স্বার্থক”।

বাংলাদেশে বেকার সমস্যা একটি বড় সমস্যা। কারিগরি প্রশিক্ষণ নিয়ে বিভিন্ন ক্ষেত্রে দক্ষতা অর্জিত হলে এই সমস্যা অনেকটাই দূর হবে। যেসব শিক্ষার্থী অর্থের অভাবে বেশিদুর পড়াশুনা চালিয়ে যেতে পারেনি কিন্তু সত্যিকার অর্থে কারিগরি প্রশিক্ষণ নিয়ে দক্ষ শ্রমিক হতে আগ্রহী, তাদের সাহায্যার্থেও এই সংস্থা অদূর ভবিষ্যতে এগিয়ে আসবে। তবে প্রতিষ্ঠাতার কথায় কিছুটা আক্ষেপ ছিল এ প্রজন্মের প্রতি। উনি বলছিলেন, “প্রতিটা কাজের মাঝে আরও বেশি স্বচ্ছতা আনার জন্য এবং কাজগুলোকে সহজ করার জন্য আমাদের বেশ কিছু স্বেচ্ছাসেবক দরকার, কিন্তু বিনা পারিশ্রমিকে, শুধু মাত্র দেশের প্রতি দায়বদ্ধতা থেকে কাজ করতে আগ্রহী মানুষ খুঁজে পাওয়া কঠিন। ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার ক্ষেত্র যত বেশি উন্মুক্ত হবে কাজের পরিমাণও তত বাড়বে, তাই এই মুহূর্তে আমরা স্বেচ্ছাসেবকের প্রয়োজনীয়তা অনেক বেশি অনুভব করছি।”

প্রবাসীরা দেশপ্রেমহীন, স্বার্থপর, তারা নিজের এবং পরিবারের ভালো ছাড়া অন্য কিছু ভাবেনা, এই ধরনের মানসিকতা যারা এখনো পোষণ করেন তাদের জন্য এই সংস্থা নিঃসন্দেহে দৃষ্টান্তমূলক উদাহরন। প্রচার, প্রসার বা অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হওয়ার প্রত্যাশা নয়, সব কিছুর ঊর্ধ্বে শুধুমাত্র দেশের অসহায়,সুবিধাবঞ্ছিত মানুষগুলোর জন্য কিছু করার দায়বদ্ধতা থেকে যারা এই মহতী উদ্যোগ হাতে নিয়েছেন তাদের ‘দেশপ্রেমিক’ ছাড়া আর কি বলা যায়?

চাইলে আপনিও হতে পারেন এই সংস্থার একজন গর্বিত সদস্য। আপনার সামান্য অনুদান একটা শিক্ষার্থীর ভবিষ্যৎ গঠনে অসামান্য অবদান রাখতে পারে। কেউ যদি স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে যুক্ত হতে চান তাহলে যোগাযোগ করতে পারেন এই ওয়েবসাইটে। ওয়েবসাইট লিঙ্ক>

http://www.bangladesch-jugendhilfe.de

এছাড়াও আপনি স্বেচ্ছাসেবক কাজের সাথে যুক্ত না হয়ে শুধুমাত্র সদস্য হয়ে থাকতে পারেন। সংস্থার সদস্যরা প্রতি ছয় মাস অন্তর ৬০ ইউরো অর্থাৎ মাসে দশ ইউরো বা তার সমপরিমাণের টাকা অনুদান দিয়ে থাকেন। জার্মানিতে অবস্থানরত বাংলাদেশী বা বিদেশী শিক্ষার্থীদের জন্য টাকার পরিমাণ কিছুটা কম। আপনি যদি সংস্থার সদস্য হিসেবেও অন্তর্ভুক্ত না হতে চান তবে নিচের একাউন্টে এককালীন অনুদান দিয়েও সাহায্য করতে পারেন।

Account holder: Bangladesch Jugendförderung e.V.

IBAN: DE91300606010007370520

BIC-Code: DAAEDEDDXXX

বিশ্বের যে প্রান্তেই থাকুন না কেন, আপনার অনুদান পৌঁছে যাবে বাংলাদেশের সুবিধাবঞ্চিত মেধাবী শিক্ষার্থীদের কাছে। মানুষ তো মানুষের জন্যই, আসুন না একটুখানি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেই তাদের জন্য!!

mm

By যূ থী

Studying Medical Diagnostic Technologies at Furtwangen University of Applied Science (HFU).

Leave a Reply