জার্মান দেশের ডায়েরী: ঈদ

শুনলাম আমার শহরে কালকে ঈদ, কোন আয়োজন চোখে পড়েনি। গত কয়দিন ধরে অসুস্থ বলে বাইরের আলো বাতাসে খুব একটা যাওয়া হয়নি। নিজেকে এক রকম চার দেয়ালে আবদ্ধ করে রেখেছিলাম। খারাপ লাগাটা উপলব্ধি করতেই মনটা নরম হয়ে আসে, বিরাট শুণ্যতায় বুকটা কেঁপে উঠে। সুস্থতা এমন একটা জিনিস, অসুস্থ না হওয়ার আগ পর্যন্ত তার মর্ম বুঝা যায়না। বিদেশে আসার পর বুঝতে পারলাম এখানে সবাই সবার আপন, আবার কেউ কারও কিছুই না। এখানকার লাইফস্টাইলটাই এমন যে প্রয়োজনের বাইরে কেউ কারও খোঁজ নেবে, এমন সময়-সুযোগ হয়ে ওঠেনা। তাই অসুস্থতা কিংবা খারাপ লাগার মুহূর্তগুলো নিজেকেই সামলাতে হয়।

দেশের বাইরে এটা আমার তৃতীয় ঈদ। প্রতিবারের মতো এবারও তেমন কোন উৎসাহ নেই ঈদকে ঘিরে। গত দুই ঈদের দিন ক্লাস করেই কেটে গেছে। এই ঈদটা হচ্ছে সাপ্তাহিক ছুটির দিনে। বুঝতে পরাছি এইবারের ঈদ একটু ভিন্নই হবে। ক্লাসের বদলে বিছানায় শুয়েই কাটাতে হবে। সময় এবং বাস্তবতা আমার কোনদিনও পছন্দের ছিলনা। আমি কোন কালেই বাস্তববাদী ছিলাম না। তাই এই প্রতিকূল অবস্থা-পরিস্থতি নিজেকে ভয়ানক রকম দূর্বল করে দিচ্ছে। দেশের ঈদের দিনগুলোর কথা খুব মনে পড়ে। কত রঙিন হয় উৎসবের আয়োজনগুলো। এই কদিনে সবার বাড়ি ফেরা দেখে আমারও খুব ইচ্ছে করছিল ছুটে যেতে। মনে পড়ে যখনই বাড়ি যাওয়ার জন্যে চট্টগ্রাম থেকে গাড়িতে ওঠতাম ঘরে না পৌঁছা পর্যন্ত একটু পর পর আম্মার ফোন। ঘরে ঢুকেই আম্মা কে জডিয়ে ধরার যে প্রশান্তি তার সাথে দুনিয়ার আর কোনকিছুর তুলনা হয়না।

জার্মান প্রবাসে ঈদ, GermanProbashe Eid

হয়তো আমি অসুস্থ বলেই খারাপ লাগাটা বেশী কাজ করছে। কত বিচিত্র মানুষের জীবন, মানুষের অনুভুতি। এই খারাপ লাগাটার অনুভূতি শুধু আমার একার না। সব প্রবাসী বাঙালির। প্রিয়জনদের ছেড়ে জীবিকা বা ভবিষ্যত ক্যারিয়ারের স্বপ্নে সবাই নিভৃতে এই ব্যাথা সয়ে চলেছে। এমন দিন/মুহূর্ত আসলেই হয়তো সবচেয়ে চন্চল ছেলেটিও লুকিয়ে চোখ ভেজায়। আবেগ প্রবণ বাঙালির কাছে এই অনুভূতি নি:স্বন্দেহে খুব কঠিনই হওয়ার কথা। এখানে ঈদ বলতে আলাদা কোন ছুটি নেই, হয়তো মুসলিম প্রধান দেশ না হওয়ার কারণে। যদি কর্মদিবসে ঈদ পড়ে তাহলে ঈদের দিন হয়তো কারও ক্লাস থাকে নয়তো পরীক্ষা থাকে। সাপ্তাহিক বন্ধের দিনে ঈদ হলে প্রায় সবারই জব থাকে। আবার এমন অনেকেই আছে যারা প্রিয়জন, ঈদ, ঈদের কষ্ট ভুলে থাকার জন্যে ইচ্ছে করেই ঈদের দিন কাজ নিয়ে থাকে। নিজেকে ব্যস্ত রেখে আড়াল করার চেষ্টা করে।

দিনশেষে আবার সেই ঘরে ফেরা, দিনশেষে আবারও একা। অন্তত একটা দিনের জন্যে সবার থেকে নিজেকে আলাদা রাখার প্রচেষ্টা। দিন কেটে যায়, নতুন দিন আসে। ব্যস্ত জীবনের ডায়েরীতে লেখা হয়ে থাকে অনেক না পাওয়ার গল্প, অনেক হাহাকারের গল্প। অভ্যস্ত জীবনের ছকে আবারও বন্দী হয়ে পড়ে মাথাচাপা দিয়ে উঠা ভোঁতা অনুভূতিগুলো। আবার স্বপ্নে বিভোর হয় হয়তো আগামীর ঈদটা সবার সাথে দেশে গিয়ে প্রিয়জনদের সাথে করার। স্বপ্ন শুধু স্বপ্নই থেকে যায়। ঈদ আসে ঈদ যায়, বালকের আর দেশে গিয়ে ঈদ করা হয়ে ওঠেনা। সামর্থ্য থাকলেও সময় এবং এখানকার রুটিন জীবন তাকে মুক্তি দেয়না। ডিসেম্বর ছাড়া এখানে সময় বের করা যে বড়ই মুশকিল!

আমিও স্বপ্ন দেখি আবারও সবার সাথে দেশে গিয়ে ঈদ আনন্দ ভাগাভাগি করার। আড্ডা-গানে ভরপুর থাকবে চারপাশ। স্কুলের মাঠের সবুজ গালিছা আমাকে টানে খুব। চরম প্রশান্তির এক জায়গা। পরের ঈদ আমাদের হবেই। সকল প্রবাসী ভাই/বোনদের প্রতি ঈদ সমবেদনা। আমিও আপনাদের কষ্টে সমব্যাথী।

দেশের সবাইকে ঈদের শুভেচ্ছা। সব ভেদাভেদ ভুলে গিয়ে সবার ঈদ আনন্দ হয়ে উঠুক নির্মল, উৎসবমূখর। নিরাপদ হউক সবার ঈদ উদযাপন। পরের আয়োজনে নিশ্চিত আমি থাকছি আপনাদের সবার সাথে,ইনশে আল্লাহ। সেই পর্যন্ত সবাই ভাল থাকুন, ভাল কাটুক আপনাদের সবার ঈদ।

ঈদের অশেষ শুভচ্ছা,
ঈদ মুবারক।

 

শফিক

এছেন, জার্মানী।

mm

By Shafiqur Rahman

কেমস্ট্রি নিয়ে পড়েছি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে! পড়ছি/পড়বঃ মাস্টার্স, জার্মান কোন একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে! :)

Leave a Reply