এক।

বাসার জানালা দিয়ে চোখ রাখলেই দেখা যায় সাইকেল আর সাইকেল। সকালে ঘুম থেকে উঠেই দেখি, ছেলে মেয়ে, পিচ্ছি, বুড়া সবাই সাইকেল চালায়। নেদারল্যান্ড কে বলে সাইকেলের দেশ।

আমার বাসার সামনেই বাগানঘেরা প্রশস্ত উঠোন। পাশে আরেকটা ঘর। কেউ থাকেনা।  উঠোন ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা লাফিয়ে লাফিয়ে স্কেটিং খেলে। দেখতে ভালোই লাগে।  আমি বাসা থেকে বেরিয়ে রাস্তায় দাঁড়াবো, এমনি গাড়িটি আমার সামনে এসে ঝাকুনি দিয়েই থেমে গেলো।গাড়ির রঙটা একটু ভিন্ন।  চকচকে কালো। ফিরে দেখি, ওমা, আমি তো আবাক!  মুচকি হেসেই যেন বলছেন, ‘আমি এখানে, এসো!’

এই ডাচ ভদ্র মানুষটার সঙ্ঘে পরিচয়  বেশী দিন হয়নি।

সবে মাত্র বাংলাদেশ ছেড়ে আসলাম। তাও ঈদের দিনে! বিশ্ববিদ্যালয় সবকিছু এরেঞ্জ করায় ট্রাই করেও ফ্লাইট চেঞ্জ করতে পারিনি। সারাদিন বাসায় বসে আছি। ভালো  লাগছেনা।

নেদারল্যান্ডে আসার মাত্র দুইদিন পর ‘সাহস’ করে বাসা থেকে বের হই। আমার সাথে ছিল তাঞ্জানিয়া ও ইউথোপিয়ার তিনজন বন্ধু। বিভিন্ন শহরে প্রায়ই অনুষ্ঠান থাকে। বিশেষ করে সাপ্তাহিক ছুটির দিনে।  একটু দূরে দেখি, বেশ কিছু মানুষের জটলা। রাস্তার পাশে পার্ক। দূর থেকে মনে হোল কোন সাংস্কৃতিক প্রোগ্রাম। আমি অপেক্ষায় থাকি। আমার আগ্রহ দেখে আফ্রিকান তিনজন এমন ভাব নিলেন, ওখানে গেলে ওরা কিছু বলতে পারে, কী দরকার- টাইপের। আমার ও শঙ্কা, ডাচ কালচার বলে  কথা। কিছু বুঝিনা। কীভাবে দাঁড়াবো, আমার দিকে ওরা থাকালে আমি ও কি থাকাব ? কোন পারিবারিক প্রোগ্রাম কি না্‌ …ভাবতে ভাবতে শঙ্কা মিশ্রিত আগ্রহ নিয়ে হাজির হই।  ওরা যেভাবে শুনছে আমিও সেভাবে অনুকরন করি। বুকে হাত দিয়ে এমন ভাব নিয়ে শুনছি, আমিই একমাত্র মন্ত্রমুগ্ধ একনিষ্ঠ শ্রোতা ! বেশ কিছু ছেলে মেয়ে হাত ধরাধরি করে নাচছে। সবার গায়ে বিশেষ রঙ্গিন জামা। আমার ঠিক পেছনে দুইজন দাড়িয়ে আছে। বুড়া-বুড়ি। আমি ওদের খেয়াল করিনি। দীর্ঘকায় ডাচদের পাশে  দাঁড়ালে নিজকে খুঁজে পাওয়া দায়। বুড়া বুঝে গেলেন, আমি এই শহরে আগুন্তুক। আমাকে কানে কানে জিজ্ঞেস করে, ‘তুমি কি জানো  এইটা কিসের প্রোগ্রাম ?’ আমি একটু ভয় পেয়ে গেলাম, কোন ভুল হল নাতো ? এমন ভাব নিলাম- একটু জানি, তবে ভালো করে  জানিনা।

বুড়া যা বললেন তার মোদ্দা কথা হচ্ছে, ১৮১৫ সালের ‘ওয়াটার লু যুদ্ধ’ নিয়ে এই অনুষ্ঠান। যারা নিহত হয়েছে তাদের নিয়ে স্মরণ সভা। কথা না বাড়িয়ে আমি প্রোগ্রামে ফিরে যাই।

এই প্রথম একজন ডাচের সাথে কথা বললাম। ভেতরটা কিছুটা হালকা মনে হচ্ছে। বুড়া ভালোই ইংরেজি বলতে পারে। আমার চেয়ে ভালো। ভদ্রলোকটাকে খুব আন্তরিক মনে হোল। কিছু মানুষ  আছে যারা নিজ থেকেই অনেক  কিছু বলে দেয়। ভাবলাম, এই সুযোগ নেয়া দরকার। কথার এক ফাঁকে বললাম, আমি বাংলাদেশ থেকে আসছি পড়াশুনা করতে। বাসা এখানেই। উনি বলে উঠলেন, ‘ ইয়েস, আই নো বাংলাদেশ, তারপর,নেহরু আর গান্ধির নাম বললেন।

প্রোগ্রাম তখনো শেষ হয়নি। আমরা হাটতে হাটতে কথা বলছি। আমি আর বুড়া হাঁটছি, বুড়ি তার কুকুর নিয়ে পেছনে পেছনে আসছে। হঠাৎ থেমে গিয়ে বলেন, এইতো আমার বাসা। এসো কফি খাই। আমি বলি, আজকে না আরেকদিন। হা বলাটা একটু অস্বাভাবিক মনে হচ্ছিলো। আর ও কিছুক্ষণ কথা বলি। ‘এইটা আমার মেইল বক্স। তোমার ফোন নাম্বার এখানে দিলে আমি পাবো’ বলে বিদায় নিলেন।

দুই।

চার-পাঁচ দিন হয়ে গেলো। ফোন করে না।বুড়ার কোন খবর নেই। বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস শুরু হোল। সবার সাথে পরিচিত হওয়া,ভাব বিনিময়। এদিকে আমার অবস্থা খারাপ। চোখ থেকে অনবরত পানি  ঝরছে। কারো দিকে ভালো করে থাকাতে পারছিনা। ব্যথা লাগছে। ঠাণ্ডা বাতাস সইতে পারিনি। কিভাবে ডাক্তার দেখাতে হয় জানা নেই। সবেমাত্র আসলাম। এক সাপ্তাহ হলনা, এখন ডাক্তার পিছনে কে ছুড়বে। সাপ্তাহ পেরিয়ে গেল। ততদিনে আমার দুই চোখ টকটকে লাল। অনবরত পানি ঝরছে। আসার সময় নাকের ড্রপ আনলেও ভুলে চোখের ড্রপ আনি নাই। মনে মনে ভাবছিলাম, এবার বুঝি অন্ধ হয়ে যাবো ! কেন যে আসলাম ? কোন বাংলাদেশি তো দূরে থাক, কেউ নেই  বলব আমার চোখটা একটু দেখ। কী সীমাহীন আসহায়ত্ত। তবু ক্লাসে যাই।

একদিন ক্লাস থেকে ফিরে রুমে শুয়ে আছি। হটাৎ মনে হল, আমি কাঁদছি। আরে, কিছুতেই কান্না থামছেনা। এক এক করে সবাইকে মনে পরতে লাগলো। চারদিকে মনে হচ্ছে বুকে জমা কষ্ট আর হাহাকার অন্যরকম এক অনুভূতি।এরিমধ্যেই মতিন ফোন দিল। আমার ছোট ভাই। চুয়েটে পরে। ফোনে ওর কণ্ঠ শুনে আমার কান্না আর বেশি…। কিছুক্ষণ পর মনে হল, আমার চোখে কোন প্রবলেম নেই। অনেক হালকা মনে হচ্ছে। হ্যাঁ, সত্যি এরপর থেকে আমার চোখ ভালো হয়ে যায় !

তিন।

কয়েকদিন পর ক্লাস থেকে ফিরে বাসায় বসে আছি।  হটাৎ দরজায় শব্দ।

আমি  জোরে বলি, ‘ প্লিজ, কাম ইন’…।

আমি তো আবাক। ডাচ ভদ্রলোক আমার রুমেই চলে আসলেন। চোখে তো প্রবলেম নাই। আমি ভুল দেখছিনা তো। না। আমি হাত ধরেই তাকে আমার বিচানায় বসতে দিই। শুরুতেই উনার কথা হচ্ছে,   ‘দেখ আমি তোমাকে ফোন করতে পারি নাই, কারণ  বক্সে কাগজটি পোকায় কেটেছে। তোমার নাম্বার বুঝা যাচ্ছেনা। তাই বাসার ঠিকানা ধরে চলে এলাম। অসময়ে এসে ডিস্টার্ব করলাম না তো?’ বলতে বলতে হাতে পোকায় কাঁটা  কাগজটি আমার সামনে মেলে ধরলেন। উনার বিনয় দেখেই আমি অবাক।  পরে অবশ্যি ইউরোপের মধ্যে ডাচদের কেই আমার সবচেয়ে বিনীত ও ভভ্র মনে হয়েছে। এখন এই ডাচ ভদ্রলোক আমি কী খেতে দিই। ওরা কী খায় তাওতো জানিনা। চা – কফি…। আমি জানতে চাই, কী খাওায়াতে পারি। মুশকিল, তখনো আমার কিছু কেনা হয়নি। কথা না বাড়িয়ে বাংলাদেশ থেকে নেয়া কিছু বিস্কুট ও ঝাল চানাচুর খেতে দিলাম। আমি বলি, ‘দিস আর ফ্রম বাংলাদেশ’। এরপর একটু করে হাতে নিলেন। চানাচুর খেয়ে তো বেচারার অবস্থা খারাপ। ‘ইটছ স্পাইছি…!’ তাড়াতাড়ি পানি দিলাম। ‘ইয়োর রুম ইস রিয়েলি নাইচ…’ বলতে বলতে আমার সাথে বের হলেন। বের হওয়ার আগে বাংলাদেশের পতাকার রঙ ও নাম খচিত একটা বেসলেট তার হাতে পরিয়ে দিলাম। ভদ্রলোক খুব খুশি। উনি আমাকে তার বাসায় নিয়ে যাবেন। আমি বলি, ‘একটু হাঁটাহাঁটি করি, তারপর যাই’।এতক্ষণে বাসার সবাই দেখে, আমার রুমে ডাচ এসে বসে আছে। আমি যে স্টুডেন্ট হাউছে থাকি এতেই অধিকাংশই আফ্রিকান।‘ব্যাটা আসছে দুই দিন হয় নাই, এখন থেকেই ডাচদের সাথে ভাব’ টাইপের অভিব্যক্তি সবার। উনি আমাকে নিয়ে একটি পথে ধরলেন। বাসা থেকে কিছুটা দূরে। আমরা একটা সরু পথ বেয়ে হাঁটছি। পিছঢালা পথ। দুই পাশে প্রচুর গাছ। ঝিরঝির ঠাণ্ডা বাতাস। এতো বিচিত্র ঘন বিশাল গাছ ও লতাপাতা। পথে কারো দেখা নেই। সূর্য ডুবতে বেশী দেরি নাই।  আমি একটু বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞেশ করি, পুরো নেদারল্যান্ড কি এমনই ?

‘না , তবে এইটা শহরের একটু বাইরে। দেশের সবচেয়ে ধনীদের একটা অংশ এদিকে থাকে। এই দেখ জাজদের বাসা’, বলে একটু থামলেন।  আমি যেন হাফ ছেড়ে বাঁচলাম। উনি এই বয়সে এতই স্মার্টভাবে হাঁটছেন দেখে একটু অবাকই হলাম।

চার।

অবশেষে ভদ্রলোক  আমাকে নিয়ে তার বাসায় আসলেন। তিন তলার বাসা। কারো সাড়া শব্দ নেই। এতক্ষণে দিন শেষে লাইটের হালকা আলোতে  আরো রহস্যময়  মনে হতে লাগলো। বাড়ীর সামনে বাগান পেরিয়ে পেছনের উঠোনে দাঁড়ালাম। আমি জিজ্ঞেস করি, এখানে আর কেউ থাকেনা কেন? ভদ্রলোকের উত্তর শুনে আমি ‘থ’ হয়ে  গেলাম।  আয় আল্লাহ আমি কোথায় এলাম।  এই লোক বাড়ায় থাকেন আজকে দুই বছর।একা। পুরা বিল্ডিঙয়ে তিনি একা। নিছের তলা লাশ ঘর! এইখানে শেষকৃত্যের অনুষ্ঠান হয় বলে আমাকে একটা গাছের নিয়ে গেলেন। আলো-আঁধারীতে দেখা আসাধরন দৃশ্য। সবুজ ঘাসের মখমল গালিচায় ঢাকা চারদিক । কিন্তু এতক্ষণে ধীরে ধীরে আমার মনে নানা প্রশ্ন, শঙ্কা তৈরি হতে লাগলো।গা ভারি ভারি লাগছে।

(চলবে…(পরবর্তী পর্ব ‘এতো ভালোবাসা, শোধ করি কীভাবে !’)

mm

By Aziz Monir

ফেলো, নেদারল্যান্ড ফেলোশিপ প্রোগ্রাম ও গণমাধ্যম গবেষক। বর্তমানে ইরাস্মাস মুণ্ডস স্কলারশিপ নিয়ে ‘কমিউনিকেশন, নিউ মিডিয়া এন্ড সোসাইটি’ বিষয়ে পড়াশুনা করছি । বিদেশ ভালো লাগেনা। দেশে ফিরতে চাই।

Leave a Reply